পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

খেলা জমিল না, কোথাও বেড়ানো গেল না। সেইজন্য পরের বছর যখন আর সকলে মামারবাড়ি গেল, তখন সে কিছুতেই যাইতে চাহিল না। পরে শুনিল সেবার নাকি সেখানে চমৎকার মেলা বসিয়াছিল, কোন রাজার দলের সঙ্গে পঁচিশটা হাতি আসিয়াছিল, আর বাজি যা-পোড়ানো হইয়াছিল সে একেবারে আশ্চর্যরকম! নন্দলালের ছোটো ভাই যখন বারবার উৎসাহ করিয়া তাহার কাছে এই-সকলের বর্ণনা করিতে লাগিল, তখন নন্দ তাহাকে একচড় মারিয়া বলিল, ‘যা যা! মেলা বক্‌বক্ করিস নে।” তাহার কেবল মনে হইতে লাগিল, সেবার সে মামারবাড়ি গিয়াও ঠকিল এবার না গিয়াও ঠকিল। তাহার মতো কপাল-মন্দ আর কেহ নাই।

 স্কুলেও ঠিক তাই। সে অঙ্ক পারে না-অথচ অঙ্কের জন্য দুই-দুইটা প্রাইজ আছে-এদিকে ভূগোল, ইতিহাস তাহার কণ্ঠস্থ কিন্তু ঐ দুইটার একটাতেও প্রাইজ নাই। অবশ্য সংস্কৃতেও সে নেহাত কাঁচা নয়, ধাতুপ্রত্যয়, বিভক্তি, সব চটপট মুখস্থ করিয়া ফেলে - চেষ্টা করিলে সে কি পড়ার বই আর অর্থপুস্তকটাকে সড়গড় করিতে পারে না? ক্ষুদিরাম পণ্ডিতমহাশয়ের প্রিয় ছাত্র-ক্লাশের মধ্যে সেই যা একটু সংস্কৃত জানে কিন্তু তাহা তো বেশি নয়। নন্দলাল ইচ্ছা করিলে কি তাহাকে হারাইতে পারে না? নন্দ জেদ করিয়া স্থির করিল, 'একবার ক্ষুদিরামকে দেখে নেব। ছোকরা এ বছর সংস্কৃতের প্রাইজ পেয়ে ভারি দেমাক করছে-আবার অঙ্কের গোল্লার জন্য আমাকে খোঁটা দিতে এসেছিল। আচ্ছা, এবার দেখা যাবে।'

 নন্দলাল কাহাকেও না জানাইয়া সেইদিন হইতেই বাড়িতে ভয়ানকভাবে পড়িতে শুরু করিল। ভোরে উঠিয়াই সে 'হসতি, হসত, হসন্তি’, শুরু করে, রাত্রেও ‘অস্তি গোদাবরী তীরে বিশাল শাল্মলী তরু’ বলিয়া তুলিতে থাকে। কিন্তু ক্লাশের ছেলেরা এ কথার বিন্দুবিসর্গও জানে না। পণ্ডিতমহাশয় যখন ক্লাশে প্রশ্ন করেন তখন মাঝে মাঝে উত্তর জানিয়াও সে চুপ করিয়া মাথা চুলকাইতে থাকে—এমন-কি, কখনো ইচ্ছা করিয়া দুইএকটা ভুল বলে—পাছে ক্ষুদিরাম তাহার পড়ার খবর টের পাইয়া আরো বেশি করিয়া পড়ায় মন দিতে থাকে। তাহার ভুল উত্তর শুনিয়া ক্ষুদিরাম মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে, নন্দলাল তাহার কোনো জবাব দেয় না। কেবল ক্ষুদিরাম নিজে যখন একেকটা ভুল করে, তখন সে মুচকি-মুচকি হাসে আর ভাবে, পরীক্ষার সময়ে অমনি ভুল করলেই বাছাধন গেছেন। তা হলে এবার আর ওকে সংস্কৃতের প্রাইজ পেতে হবে না।'

 ওদিকে ইতিহাসের ক্লাশে নন্দলালের প্রতিপত্তি কমিতে লাগিল। কারণ ইতিহাস আর ভূগোল নাকি একরকম করিয়া শিখিলেই পাশ করা যায়—তাহার জন্য নন্দর কোনো ভাবনা নাই। তাহার সমস্ত মনটা রহিয়াছে ঐ সংস্কৃত পড়ার উপরে-অর্থাৎ সংস্কৃতের প্রাইজটার উপরে। একদিন মাস্টারমহাশয় বলিলেন, “কি হে নন্দলাল, আজকাল বাড়িতে কিছু পড়াশুনা কর না নাকি? তা না হলে সব বিষয়েই যে তোমার এমন দুর্দশা হচ্ছে, তার অর্থ কি? বাড়িতে কি পড় বল দেখি।” নন্দ আরেকটু হইলেই বলিয়া ফেলিত, “আজ্ঞে, সংস্কৃত পড়ি। কিন্তু কথাটাকে হঠাৎ সামলাইয়া, “আজ্ঞে সংস্কৃত-না সংস্কৃত নয়” বলিয়াই সে ভারি থতমত খাইয়া থামিয়া গেল। মাস্টারমহাশয় এক ধমক দিয়া বলিলেন, “আজ্ঞে সংস্কৃত—না সংস্কৃত নয়—এর অর্থ কি?” ক্ষুদিরাম তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, “কই। সংস্কৃতও তো কিছু পারে না।” শুনিয়া ক্লাশসুদ্ধ ছেলে হাসিতে লাগিল।

ইস্কুলের গল্প
১২৩