পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৩৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
দাশুর কীর্তি

 নবীনচাঁদ স্কুলে এসেই বলল, কাল তাকে ডাকাতে ধরেছিল। শুনে স্কুলসুদ্ধ সবাই হাঁ হাঁ করে ছুটে আসল। “ডাকাতে ধরেছিল? বলিস কি রে?” ডকিতি না তো কি? বিকেলবেলায় সে জ্যোতিলালের বাড়িতে পড়তে গিয়েছিল, সেখান থেকে ফিরবার সময়ে ডাকাতেরা তাকে ধরে, তার মাথায় চাঁটি মেরে, তার নতুন কেনা শখের পিরানটিতে কাদাজলের পিচকিরি দিয়ে গেল। আর যাবার সময় বলে গেল, “চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক্-নইলে দড়া্‌ম্ করে তোর মাথা উড়িয়ে দেব।” তাই সে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে রাস্তার ধারে প্রায় বিশ মিনিট দাঁড়িয়েছিল। এমন সময়ে তার বড়োমামা এসে তার কান ধরে বাড়িতে নিয়ে বললেন, “রাস্তায় সঙ সেজে এয়ার্কি করা হচ্ছিল?” নবীনচাঁদ কাঁদ-কাঁদ গলায় বলে উঠল “আমি কি করব? আমায় ডাকাতে ধরেছিল-” শুনে তার মামা প্রকাণ্ড এক চড় তুলে বললেন, “ফের জ্যাঠামি!” নবীনচাঁদ দেখল মামার সঙ্গে তর্ক করাই বৃথা-কারণ, সত্যিসত্যিই তাকে যে ডাকাতে ধরেছিল, এ কথা তার বাড়ির কাউকে বিশ্বাস করানো শক্ত। সুতরাং তার মনের দুঃখ এতক্ষণ মনের মধ্যেই চাপা ছিল। স্কুলে এসে আমাদের কাছে বসতে না বসতেই সে দুঃখ একেবারে উথলিয়ে উঠল।

 যাহোক, স্কুলে এসে তার দুঃখ বোধ হয় অনেকটা দূর হতে পেরেছিল, কারণ, স্কুলের অন্তত অর্ধেক ছেলে তার কথা শুনবার জন্য একেবারে ব্যস্ত হয়ে ঝুঁকে পড়েছিল, এবং তার প্রত্যেকটি ঘামাচি, ফুসকুড়ি আর চুলকানির দাগটি পর্যন্ত তারা আগ্রহ করে ডাকাতির সুস্পষ্ট প্রমাণ বলে স্বীকার করেছিল। দুয়েকজন, যারা তার কনুয়ের আঁচড়টাকে পুরনো বলে সন্দেহ করেছিল, তারাও বলল যে হাটুর কাছে যে ছুড়ে গেছে সেটা একেবারে টাটকা নতুন। কিন্তু তার পায়ের গোড়ালিতে যে ঘায়ের মতো ছিল সেটাকে দেখে কেষ্টা যখন বলল, “ওটা তো জুতোর ফোস্কা, তখন নবীনচাঁদ ভয়ানক চটে বলল, “যাও, তোমাদের কাছে আর কিচ্ছু বলব না!” কেষ্টাটার জন্য আমাদের আর কিছু শোনাই হল না।

 ততক্ষণে দশটা বেজে গেছে, ঢং ঢং করে স্কুলের ঘণ্টা পড়ে গেল। সবাই যে যার ক্লাশে চলে গেলাম, এমন সময়ে দেখি পাগলা দাশু একগাল হাসি নিয়ে ক্লাশে ঢুকছে। আমরা বললাম, “শুনেছিস? কাল নবুকে ডাকাতে ধরেছিল।” যেমন বলা, অমনি দাশরথি হঠাৎ হাত-পা ছেড়ে বইটই ফেলে খ্যাঃ খ্যাঃ খ্যাঃ খ্যাঃ করে হাসতে হাসতে একেবারে মেঝের ওপর বসে পড়ল! পেটে হাত দিয়ে গড়াগড়ি করে, একবার চিত হয়ে, একবার উপুড় হয়ে, তার হাসি আর কিছুতেই থামে না। দেখে আমরা তো অবাক। পণ্ডিতমশাই ক্লাশে এসেছেন, তখনো পুরোদমে তার হাসি চলছে। সবাই ভাবল, ‘ছোঁড়াটা খেপে গেল নাকি?' যা হোক, খুব খানিকটা হুটোপুটির পর সে ঠাণ্ডা হয়ে, বইটই গুটিয়ে বেঞ্চের ওপর উঠে বসল। পণ্ডিতমশাই বললেন, “ওরকম হাসছিলে কেন?” দাশু নবীনচাঁদকে দেখিয়ে বলল, “ঐ ওকে দেখে।” পণ্ডিতমশাই খুব কড়ারকমের ধমক

১৩০
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২