পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ভোলানাথ আবার বলিল, “আমার মনে হচ্ছিল, বোধ হয় ও নেয়—তাই তো বললাম। আর তো কিছু আমি বলি নি।” মাস্টারমহাশয় গম্ভীর হইয়া বলিলেন, “যাও, হরিদাসের কাছে ক্ষমা চাও।” তখনই ভোলানাথের কান ধরিয়া হরিদাসের কাছে ক্ষমা চাওয়ানো হইল। কিন্তু তবু কি তাহার চেতনা হয়?

 ভোলানাথ সাঁতার জানে না, কিন্তু তবু সে বাহাদুরি করিয়া হরিশের ভাইকে সাঁতার শিখাইতে গেল। রামবাবু হঠাৎ ঘাটে আসিয়া পড়েন তাই রক্ষা। তা না হইলে দুজনকেই সেদিন ঘোষ পুকুরে ডুবিয়া মরিতে হইত। কলিকাতায় মামার নিষেধ না শুনিয়া চলতি ট্রাম হইতে নামিতে গিয়া ভোলানাথ কাদার উপর যে আছাড় খাইয়াছিল, তিনমাস পর্যন্ত তাহার আঁচড়ের দাগ তাহার নাকের উপর ছিল। আর বেদেরা শেয়াল ধরিবার জন্য যেবার ফাঁদ পাতিয়া রাখে, সেবার সেই ফাঁদ ঘাঁটিতে গিয়া ভোলানাথ কিরকম আটকা পড়িয়াছিল, সে কথা ভাবিলে আজও আমাদের হাসি পায়। কিন্তু সবচাইতে যেবার সে জব্দ হইয়াছিল সেবারের কথা বলি শোন।

 আমাদের স্কুলে আসিতে হইলে কলেজবাড়ির পাশ দিয়া আসিতে হয়। সেখানে একটা ঘর আছে তাহাকে বলে লেবরেটরি। সে ঘরে নানারকম অদ্ভুত কলকারখানা থাকিত। ভোলানাথের সবটাতেই বাড়াবাড়ি, সে একদিন একেবারে কলেজের ভিতরে গিয়া দেখিল, একটা কলের চাকা ঘুরানো হইতেছে আর কলের একদিকে চড়াক্ চড়াক্ করিয়া বিদ্যুতের মতো ঝিলিক জ্বলিতেছে। দেখিয়া ভোলানাথের ভারি শখ হইল, সেও একবার কল ঘুরাইয়া দেখে! কিন্তু কলের কাছে যাওয়ামাত্র কে একজন তাহাকে এমন ধমক দিয়া উঠিল, যে ভয়ে এক দৌড়ে সে ইস্কুলে আসিয়া হাঁপাইতে লাগিল। কিন্তু কলটা একবার নাড়িয়া দেখিবার ইচ্ছাটা তাহার কিছুতেই গেল না।

 একদিন বিকালে যখন সকলে বাড়ি যাইতেছি, তখন ভোলানাথ যে কোন সময়ে কলেজবাড়িতে ঢুকিল তাহা আমরা বুঝিতে পারি নাই: সে চপিচুপি কলেজবাড়ির লেবরেটরি বা যন্ত্রখানায় ঢুকিয়া অনেকক্ষণ এদিক-ওদিক চাহিয়া দেখে ঘরে কেউ নাই, তখনই ভরসা করিয়া ভিতরে ঢুকিয়া সে কলকব্জা দেখিতে লাগিল। সেইদিনের সেই কলটা আলমারির আড়ালে উঁচু তাকের উপর তোলা রহিয়াছে, সেখানে তাহার হাত যায় না। অনেক কষ্টে সে টেবিলের পিছন হইতে একখান বড়ো চৌকি লইয়া আসিল। এদিকে কখন যে কলেজের কর্মচারী চাবি দিয়া ঘরের তালা আঁটিয়া চলিয়া গেল, সেও ভোলানাথকে দেখে নাই, ভোলানাথেরও সেদিকে চোখ নাই। চৌকির উপর দাঁড়াইয়া ভোলানাথ দেখিল কলটার কাছে একটা অদ্ভুত বোতল। সেটা যে বিদ্যুতের বোতল ভোলানাথ তাহা জানে না। সে বোতলটাকে ধরিয়া সরাইয়া রাখিতে গেল। অমনি বোতলের বিদ্যুৎ হঠাৎ তাহার শরীরের ভিতর দিয়া ছুটিয়া গেল, মনে হইল যেন তাহার হাড়ের ভিতর পর্যন্ত কিসের একটা ধাক্কা বাজিয়া উঠিল, সে মাথা ঘুরিয়া চৌকি হইতে পড়িয়া গেল।

 বিদ্যুতের ধাক্কা খাইয়া ভোলানাথ খানিকক্ষণ হতভম্ব হইয়া রহিল! তার পর ব্যস্ত হইয়া পলাইতে গিয়া দেখে দরজা বন্ধ। অনেকক্ষণ দরজায় ধাক্কা দিয়া, কিল, ঘুষি,

১৩৬
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২