পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সকলে হাফ হাড়িয়া বাঁচিল, কিন্তু পণ্ডিতমশাই কেন যে হঠাৎ নরম হইয়া গেলেন কেহই তাহা বুঝিল না। পণ্ডিতমশাইয়ের মনে হঠাৎ যে তার নিজের ছেলেবেলার কোন দুষ্টুমির কথা মনে পড়িয়া গেল, তাহা কেবল তিনিই জানেন।

সন্দেশ-আষাঢ়, ১৪২৪


দাশুর খ্যাপামি

 স্কুলের ছুটির দিন। স্কুলের পরেই ছাত্রসমিতির অধিবেশন হবে। তাতে ছেলেরা মিলে অভিনয় করবে। দাশুর ভারি ইচ্ছা ছিল সেও একটা কিছু অভিনয় করে। একে ওকে দিয়ে সে অনেক সুপারিশও করিয়েছিল, কিন্তু আমরা সবাই কোমর বেঁধে বললাম, ‘সে কিছুতেই হবে না।’

 সেই তো গতবার যখন আমাদের অভিনয় হয়েছিল, তাতে দাশু সেনাপতি সেজেছিল। সেবারে সে অভিনয়টা একেবারে মাটি করে দিয়েছিল। যখন ত্রিচূড়ের গুপ্তচর সেনাপতির সঙ্গে ঝগড়া করে তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করে বলল, “সাহস থাকিলে তবে খোল তলোয়ার।” দাশুর তখন, “তবে আয়, সম্মুখ সমরে”—বলে তখনি তলোয়ার খুলবার কথা। কিন্তু দাশুটা অনাড়ির মতো টানাটানি করতে গিয়ে তলোয়ার তো খুলতে পারলই না, মাঝে থেকে ঘাবড়ে গিয়ে কথাগুলোও বলতে ভুলে গেল। তাই দেখে গুপ্তচর আবার, “খোলো তলোয়ার!” বলে হুংকার দিয়ে উঠল। দাশুটা এমনি বোকা, সে অমনি, “দাঁড়া, দেখছিস না বকলস আটকিয়ে গেছে” বলে চেঁচিয়ে তাকে এক ধমক দিয়ে উঠল। ভাগ্যিস আমি তাড়াতাড়ি তলোয়ারটা খুলে দিলাম, তা না হলে ঐখানেই অভিনয় বন্ধ হয়ে যেত। তার পর শেষের দিকে রাজা যখন জিজ্ঞাসা করলেন, “কিবা চাহ পুরস্কার, কহ সেনাপতি,” তখন দাশুর বলবার কথা ছিল, “নিত্যকাল থাকে যেন রাজপদে মতি”, কিন্তু দাশুটা তা না বলে, তার পরের আরেকটা লাইন আরম্ভ করেই, হঠাৎ জিভ কেটে, “ঐ যাঃ। ভুলে গেছিলাম” বলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল। আমি কটমট করে তাকাতে, সে তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে ঠিক লাইনটা আরম্ভ করল।

 তাই এবারে তার নাম হতেই আমরা জোর করে বলে উঠলাম, “না, সে কিছুতেই হবে না।” বিশু বলল, “দাশু একটিং করবে? তা হলেই চিত্তির।” ট্যাঁপা বলল, তার চাইতে ভজু মালিকে ডেকে আনলেই হয়।” দাশু বেচারা প্রথম খুব মিনতি করল, তার পর চটে উঠল, তার পর কেমন মুষড়ে গিয়ে মুখ হাঁড়ি করে বসে রইল। যে কদিন আমাদের তালিম চলছিল, দাশু রোজ এসে চুপটি করে হলের এক কোনায় বসে বসে আমাদের অভিনয় শুনত। ছুটির কয়েকদিন আগে থেকে দেখি, ফোর্থ ক্লাশের ছোটো গণ্‌শার সঙ্গে দাশুর ভারি ভাব হয়ে গেছে। গণ্‌শা ছেলেমানুষ, কিন্তু সে চমৎকার আবৃত্তি করতে পারে—তাই তাকে দেবদূতের পার্ট দেওয়া হয়েছে। দাশু রোজ তাকে

১৪২
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২