পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নানারকম খাবার এনে খাওয়ায়, রঙিন পেনসিল আর ছবির বই এনে দেয়, আর বলে যে ছুটির দিন তাকে একটা ফুটবল কিনে দেবে। হঠাৎ গণ্‌শার উপর দাশুর এতখানি টান হবার কোনো কারণ আমরা বুঝতে পারলাম না। কেবল দেখতে পেলাম, গণ্‌শাটা খেলনা আর খাবার পেয়ে ভুলে ‘দাশুদা’র একজন পরম ভক্ত হয়ে উঠতে লাগল।

 ছুটির দিনে আমরা যখন অভিনয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, তখন আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারা গেল। আড়াইটা বাজতে না বাজতে দেখা গেল, দাশুভায়া সাজঘরে ঢুকে পোশাক পরতে আরম্ভ করেছে। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, “কি রে? তুই এখানে কি করছিস?” দাশু বলল, “বাঃ, পোশাক পরব না?” আমি বললাম, “পোশাক পরবি কি রে? তুই তো আর একটিং করবি না।” দাশু বলল, “বাঃ, খুব তো খবর রাখ। আজকে দেবদূত সাজবে কে জান না?” শুনে হঠাৎ আমাদের মনে কেমন একটা খটকা লাগল, আমি বললাম, “কেন, গণ্‌শার কি হল?” দাশু বলল, “কি হয়েছে, তা গণ্‌শাকে জিজ্ঞেস করলেই পার।” তখন চেয়ে দেখি, সবাই এসেছে, কেবল গণ্‌শাই আসে নি। অমনি রামপদ, বিশু আর আমি, ছুটে বেরাম গণ্‌শার খোঁজে।

 সারাটি স্কুল খুজে, শেষটায় টিফিন ঘরের পিছনে হতভাগাকে খুঁজে পাওয়া গেল। সে আমাদের দেখেই পালাবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমরা তাকে চটপট প্রেপ্তার করে টেনে নিয়ে চললাম। গণ্‌শা কাঁদতে লাগল, “না আমি কক্ষনো একটিং করব না, তা হলে দাশুদা আমায় ফুটবল দেবে না। আমরা তবু তাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছি, এমন সময় অঙ্কের মাস্টার হরিবাবু সেখানে এসে উপস্থিত। তিনি আমাদের দেখেই ভয়ংকর লাল চোখ করে ধমক দিয়ে উঠলেন, “তিন-তিনটে ধাড়ি ছেলে মিলে ঐ কচি ছেলেটার পেছনে লেগেছিস? তোদের লজ্জাও করে না?” বলেই আমাকে আর বিশুকে একেকটি চড় মেরে আর রামপদর কান মলে দিয়ে হন্‌হন্ করে চলে গেলেন। এই সুযোগে হাতছাড়া হয়ে গশচন্দ্র আবার চম্পট দিল। আমরাও অপমানটা হজম করে ফিরে এলাম। এসে দেখি, দাশুর সঙ্গে রাখালের মহা ঝগড়া লেগে গেছে। রাখাল বলছে, “তোকে আজ কিছুতেই দেবদূত সাজতে দেওয়া হবে না।” দাশু বলছে, “বেশ তো, তা হলে আর কেউ দেবদূত সাজুক, আমি রাজা কিংবা মন্ত্রী সাজি। পাঁচ-ছটা পার্ট আমার মুখস্থ হয়ে আছে। এমন সময়ে আমরা এসে খবর দিলাম যে, গণশাকে কিছুতেই রাজী করানো গেল না। তখন অনেক তর্কবিতর্ক আর ঝগড়াঝাটির পর স্থির হল যে, দাশুকে আর ঘাঠিয়ে দরকার নেই, তাকেই দেবদূত সাজতে দেওয়া হোক। শুনে দাশু খুব খুশি হল আর আমাদের শাসিয়ে রাখল যে, “আবার যদি তোরা কেউ গোলমাল করিস, তা হলে কিন্তু গতবারের মতো সব ভণ্ডুল করে দেব।”

 তার পর অভিনয় আরম্ভ হল! প্রথম দৃশ্যে দাশু বিশেষ কিছু গোলমাল করে নি, খালি স্টেজের সামনে একবার পানের পিক ফেলেছিল। কিন্তু তৃতীয় দৃশ্যে এসে সে একটু বাড়াবাড়ি আরম্ভ করল। এক জায়গায় তার খালি বাবার কথা, “দেবতা বিমুখ হলে মানুষে কি পারে?” কিন্তু সে এই কথাটুকুর আগে কোথেকে আরো চার-পাঁচ লাইন জুড়ে দিল। আমি তাই নিয়ে আপত্তি করেছিলাম, কিন্তু দাশু বলল, “তোমরা যে লম্বা-লম্বা বক্তৃতা কর সে

ইস্কুলের গল্প
১৪৩