পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 সার ওয়াল্টার র‌্যালে যখন বিলাতে আলু আর তামাকের প্রচলন করলেন, তখনো তাঁকে রীতিমত নাকাল হতে হয়েছিল। শোনা যায়, তিনি একদিন খুব আরাম করে নিজের ঘরে বসে ‘পাইপ’ মুখে দিয়ে তামাক টানছিলেন, এমন সময় তাঁর চাকর এসে সেই ব্যাপার দেখে, মনিবের মুখে আগুন লেগেছে মনে করে, একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে সে এক বালতি জল নিয়ে সার ওয়াটারের মাথায় ঢেলে দিল। আলু খেতেও প্রথমটা লোকে কম আপত্তি করে নি। আলু ভয়ানক বিষাক্ত জিনিস, ‘আলু খেয়ে লোক মরে যাচ্ছে', এইরকম সব অদ্ভুত গুজব চারিদিকে রাষ্ট্র হয়ে বহুদিন পর্যন্ত লোকের মনে ভয় জন্মিয়ে রেখেছিল।

 কলকাতায় হাওড়ার পোল যখন তৈরি হয় নি, তখন একজন সাহেব বলেন যে নৌকার উপর খিলান ভাসিয়ে এইরকম পোল তৈরি হতে পারে। এ কথাটা সে সময়ে লোকের কাছে এমনই অদ্ভুত ঠেকেছিল যে খবরের কাগজে পর্যন্ত সেই বেচারার নামে নানারকম ঠাট্টা-তামাশা বেরিয়েছিল। অথচ এখন হাজার হাজার লোকে প্রতিদিন পোলের উপর যাওয়া-আসা করছে—সেটা বাস্তবিক একটা অদ্ভুত ব্যাপার কিনা, কেউ সে কথা ভেবে দেখবার অবসর পায় না।

 রেলগাড়ির প্রচলনও এমনি করেই হয়েছিল। প্রায় একশো বৎসর আগে জর্জ স্টিফেনসন বাষ্পের জোরে গাড়ি চালিয়ে তাতে লোকের যাতায়াতের ব্যবস্থা করবার প্রস্তাব করেন। তখন সে প্রস্তাবে এতরকম আপত্তি উঠেছিল যে, ক্রমে তর্কটা পার্লামেট পর্যন্ত গড়ায়। শেষটায় অনেক ঝগড়াঝাটি গণ্ডগোলের পর, স্টিফেনসনকে নানারকম জেরা করে তার পর অনুমতি দেওয়া হল—“আচ্ছা, তোমার রেলগাড়িটা নাহয় একবার পরীক্ষা করে দেখা যাক!” স্টিফেনসন সহজে জেদ ছাড়বার লোক ছিলেন না-তাই তিনি শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে ছাড়েন নি।

 এই জর্জ স্টিফেনসনের জীবনের কথা অতি অদ্ভুত। নিতান্ত গরিবের ঘরে যার জন্ম, যে লেখাপড়ার কোনোরকম সুযোগ পায় নি এবং ত্রিশ বৎসর বয়স পর্যন্ত কেবল কয়লার খনিতে সামান্য কাজ করেই জীবন কাটিয়েছে, তার মনে এমন আশ্চর্য শক্তি আসে কোথা হতে, ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। স্টিফেনসনের ছয় ভাইবোন। বাপ-মা অত্যন্ত গরিব, কাজেই ছেলেবেলা থেকেই সব কটি ভাইকে টাকা উপার্জনের চেষ্টা করতে হত। তারা নানান কাজ করে একেকজন দিনে প্রায় দু-আনা রোজগার করত। খনিতে নানারকম কল-কারখানা থাকে, সেগুলার উপর জর্জের ভারি নজর ছিল। সুযোগ পেলেই সে সেগুলাকে নেড়েচেড়ে তার ভিতরের কলকব্জা খুলে দেখত। বইটই কিছুমাত্র না পড়েও কেবল নিজে দেখেশুনে এ-সকল বিষয়ে তার আশ্চর্য দখল জমেছিল। সে সময়ে কয়লার খনিতে যে-সকল এঞ্জিন ব্যবহার হত তাদের ‘খাড়া এঞ্জিন’ বলা যায়—অর্থাৎ সে এঞ্জিন এক জায়গায় খাটানো থাকে। তার চাকার সঙ্গে দড়ি শিকল বা লোহার হাতল জুড়ে গাড়ি টানা, মোট বওয়া, জিনিসপত্র উঠানো-নামানো প্রভৃতি নানারকম কাজ চালানো হয়। সেই সময় হতেই চাকায়-বসানো চলন্ত এঞ্জিন গড়বার খেয়াল স্টিফেনসনের মাথায় চেপেছিল।

 যা হোক ক্রমে স্টিফেনসনের অবস্থার উন্নতি হতে লাগল। ক্রমে তার সপ্তাহে বারো

১৬৮
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২