পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

যেমন বুদ্‌বুদ্ ওঠে সূর্যের গায়ে তেমনি আগুনের ফোস্কা ওঠে আর ফেটে পড়ে। একএকটি বুদ্‌বুদ্ মাঝে মাঝে এত বড়ো হয় যে, কালো কাঁচ দিয়ে দেখলে সেগুলোকে শুধু চোখেই দেখতে পার। ঐরকম এক-একটা বুদ্‌বুদের মধ্যে ইচ্ছা করলে, দু-দশটা পৃথিবীকে স্বচ্ছন্দে পুরে রাখা যায়। ঐ ফোস্কাগুলি এক-একটি আগুনের ঘূর্ণিচক্র, তার চারিদিকে দম্‌কা আগুন ঠেলে উঠছে।

 সূর্যের তেজ এত বেশি যে তার চারিদিকে যে আগুনের শিখা ঝড়ের মতো উঠছে আর পড়ছে, সেগুলি আমরা দেখতেই পাই না। সূর্যের যখন পূর্ণগ্রহণ হয়, চাঁদটা মাঝে পড়ে তার চক্‌চকে শরীরটিকে আড়াল করে ফেলে, তখন তাদের চেহারা দেখা যায় আগুনের লকলকে জিভের মতো। শিখাগুলি হাজার হাজার মাইল জুড়ে দপ্দপ্ করে জ্বলতে থাকে, কখনো আগুনের ঝাপটা দিয়ে মিনিটে ছয় হাজার মাইল ছুটে যায়, কখনো শান্ত মেঘের মতো সূর্যের গায়ে ভেসে বেড়ায়। এক-একটাকে দেখে মনে হয় যেন আগুনের ফোয়ারা উঠছে। তার মধ্যে যদি আমাদের এই পৃথিবীটিকে ছেড়ে দেও, এটি চক্ষের নিমেষে গলে বাষ্প হয়ে কোথায় যে মিলিয়ে যাবে সে আর খুঁজেই পাবে না। সূর্যের চারিদিকের এই অগ্নিমেঘের স্তরটিকে দিনের আলোতে দেখবার জন্য পণ্ডিতেরা আশ্চর্যরকম উপায় বার করেছেন, তার জন্য তাঁদের এখন আর গ্রহণের অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় না।

 কিন্তু সূর্যের চারিদিকে আর-একটি জিনিস আছে যেটিকে গ্রহণ ছাড়া দেখবার জো নেই—সেটিকে সূর্যের কিরীট (Corona) বলা যায়। পৃথিবীর চারিদিকে যেমন বাতাসের আবরণ, সূর্যের চারিদিকেও তেমনি বহুদূর পর্যন্ত এই কিরীটের ঢাকনি। যাঁরা সূর্যের পূর্ণগ্রহণ দেখেছেন তাঁরা বলেন, এমন আশ্চর্য অদ্ভুত দৃশ্য আর কিছু নেই। যখন গ্রহণ সম্পূর্ণ হয়ে অসিতে থাকে, চাঁদের কালো ছায়া যখন চোখের সামনে পাহাড় সমুদ্র সব গ্রাস করে ফেলতে থাকে, আকাশের অদ্ভুত ফ্যাকাশে রঙ আর পৃথিবীর অন্ধকার দেখে, পশুপাখি পর্যন্ত ভয়ে স্তবদ্ধ হয়ে যায়, সেই সময়ে সূর্যের তেজ চাপা পড়ে তার আশ্চর্য কিরীটের শোভা দেখা যায়। শুধু এই কিরীটের সুন্দর স্নিধ আলো দেখবার জন্যই কত লোকে পয়সাকড়ি খরচ করে হাজার হাজার মাইল পার হয়ে গ্রহণ দেখতে যায়। এই কিরীটের চেহারা সব সময়ে একরকম থাকে না-কখনো সেটা চারিদিকে বেশ সমান ভাবে গোল হয়ে থাকে, কখনো তার মধ্যে ভয়ানক ঝড় ঝাপটার লক্ষণ দেখা যায়-কখনো তা থেকে লম্বালম্বা ছটা বেরিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে;। মোটের উপর বলা যায়, যে সময়ে সূর্যের গায়ে ফোস্কা বেশি দেখা যায় সেই সময়ে তার আগুনের শিখাগুলিরও অত্যাচার বাড়ে আর সেই অত্যাচারে তার কিরীটটিকেও ঘাঁটিয়ে তোলপাড় করে তোলে। আমরা জানি যে পৃথিবীটা চব্বিশ ঘটায় একবার পাক খায়, তাতেই আমাদের দিন-রাত হয়। সূর্যটাকে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে সেও ভয়ংকর বেগে লাটুর মতো ক্রমাগত পাক খাচ্ছে—কিন্তু একটি পাক খেতে তার ছাব্বিশ দিন সময় লাগে।

 অনেকের বিশ্বাস এই যে, সূর্যটা এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে আছে—আর পৃথিবী গ্রহ চন্দ্র সবাই মিলে ঘুরতে ঘুরতে তার চারিদিক প্রদক্ষিণ করছে। কিন্তু আসলে তা

নানা নিবন্ধ
১৭১