আমি বললাম, “সবটা তো ভালো করে বোঝা গেল না।”
কাক গম্ভীর হয়ে বলল, “হ্যাঁ, ভারি শক্ত, সকলে বুঝতে পারে না। একবার এক খদ্দের এসেছিল তার ছিল টেকো মাথা—”
এই কথা বলতেই বুড়ো মাৎ-মাৎ করে তেড়ে উঠে বলল, “দেখ্! ফের যদি টেকো মাথা বলবি তো হুঁকো দিয়ে এক বাড়ি মেরে তোর শ্লেট ফাটিয়ে দেব।”
কাক একটু থতমত খেয়ে কি যেন ভাবল, তার পর বলল, “টেকো নয়, টেপো মাথা, যে মাথা টিপে-টিপে টোল খেয়ে গিয়েছে।”
বুড়ো তাতেও ঠাণ্ডা হল না, বসে-বসে গজ্গজ্ করতে লাগল। তাই দেখে কাক বলল, “হিসেবটা দেখবে নাকি?”
বুড়ো একটু নরম হয়ে বলল, “হয়ে গেছে? কই দেখি।”
কাক আমনি “এই দেখ” বলে তার শ্লেটখানা ঠকাস্ করে বুড়োর টাকের উপর ফেলে দিল। বুড়ো তৎক্ষণাৎ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল আর ছোটো ছেলেদের মতো ঠোট ফুলিয়ে “ও মা, ও পিসি, ও শিবুদা” বলে হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে লাগল।
কাকটা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে, বলল, “লাগল নাকি! ষাট-ষাট।”
বুড়ো অমনি কান্না থামিয়ে বলল, “একষট্টি, বাষট্টি, চৌষট্টি—”
কাক বলল, “পঁয়ষট্টি।”
আমি দেখলাম আবার বুঝি ডাকাডাকি শুরু হয়, তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, “কই হিসেবটা তো দেখলে না?”
বুড়ো বললে “হ্যাঁ-হ্যাঁ তাই তো! কি হিসেব হল পড় দেখি।”
আমি শ্লেটখানা তুলে দেখলাম ক্ষুদে-ক্ষুদে অক্ষরে লেখা রয়েছে—
“ইয়াদি কির্দ অত্র কাকালতনামা লিখিতং শ্রীকাক্কেশ্বর কুচ্কুচে কার্যঞ্চাগে। ইমারৎ খেসারৎ দলিল দস্তাবেজ। তস্য ওয়ারিশানগণ মালিক দখলিকার সত্ত্বে অত্র নায়েব সেরেস্তায় দস্ত বদস্ত কায়েম মোকররী পত্তনীপাট্টা অথবা কাওলা কবুলিয়ৎ। সত্যতায় কি বিনা সত্যতায় মুনসেফী আদালতে কিম্বা দায়রায় সোপর্দ আসামী ফরিয়াদী সাক্ষী সাবুদ গয়রহ মোকৰ্দমা দায়ের কিম্বা আপোস মকমল ডিক্রীজারী নিলাম ইস্তাহার ইত্যাদি সর্বপ্রকার কর্তব্য বিধায়—”
আমার পড়া শেষ না হতেই বুড়ো বলে উঠল, “এ-সব কি লিখেছ আবোল তাবোল?”
কাক বলল, “ও-সব লিখতে হয়। তা না হলে আদালতে হিসেব টিকবে কেন? ঠিক চৌকস-মতো কাজ করতে হলে গোড়ায় এ-সব বলে নিতে হয়।”
বুড়ো বলল, “তা বেশ করেছ,কিন্তু আসল হিসেবটা কি হল তা তো বললে না?”
কাক বলল, “হ্যাঁ, তাও তো বলা হয়েছে। ওহে, শেষ দিকটা পড় তো?”
আমি দেখলাম শেষের দিকে মোটা-মোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে—
সাত দুগুণে ১8, বয়স ২৬ ইঞ্চি, জমা ৴২॥ সের, খরচ ৩৭ বৎসর।