পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৮৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 গ্রীস প্রভৃতি দেশে এক সময়ে অতি সুন্দর মাটির ঘড়া ও ফুলদানি তৈয়ারি হইত কিন্তু গ্রীক ও রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস হইবার পর এই শিল্প নষ্ট হইয়া যায়। ইহার পর বহু বৎসর পর্যন্ত ইউরোপে মাটির জিনিস বলিতে সাধারণ মোটা বাসনপত্রই বুঝিত। তার পর মুসলমানদের দৌলতে যখন এই লুপ্ত শিল্প আবার জাগিয়া উঠে তখন হইতে দক্ষিণ ইউরোপে, বিশেষত ইটালিতে নানারূপ শিল্পের বাসন দেখা দিতে লাগিল। তখনো তাহারা চীনামাটি গড়িতে পারে নাই বটে কিন্তু মাটির উপর সাদা পালিশ চড়াইয়া তাহার চমৎকার নকল করিতে শিখিয়াছিল। বহুদিন পর্যন্ত এই ব্যবসায় ইটালির একচেটিয়া ছিল।

 যাহাদের চেষ্টায় ও যত্নে এই শিল্পের ব্যবসা ইউরোপের চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে, তাহাদের মধ্যে প্যালিসির নাম বিশেষভাবে করা যায়। বার্নার্ড প্যালিসির বাড়ি ছিল ফ্রান্স দেশে। সেখানে ছবি আঁকিয়া, কাঁচ রঙাইয়া ও জরীপের কাজে ঘুরিয়া ঘুরিয়া তাঁহার দিন যাইত। হয়তো এইভাবেই তাহার সারা জীবন কাটিয়া যাইত। কিন্তু একদিন তিনি একখানা মাটির পেয়ালা দেখিলেন, তেমন জিনিস আর তিনি কখনো দেখেন নাই-বিশেষত তাহার উপর যে পালিশ করা এনামেলের কাজ ছিল, তাহাতেই প্যালিসিকে একেবারে মুগ্ধ করিয়া ফেলিল। প্যালিসি তখন একেবারে প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিলেন, ঐরকম পালিশের সংকেত না শিখিয়া তিনি ছাড়িবেন না।

 সেইদিন হইতে তাহার আর অন্য চিন্তা নাই, জীবনের আর কোনো কাজ নাই, তিনি কেবল চুল্লি জ্বালাইয়া ভাঙা পাথর আর মাটির মসলা গলাইতেছেন, আর দেখিতেছেন পালিশ ঠিক হইল কিনা। নিজে লেখাপড়া জানেন না, কোনোদিন এ ব্যবসা শিখেন নাই, অথচ উৎসাহের তাড়নায় শক্তি সময় ও অর্থ অজস্র ঢালিয়া দিতেছেন-তাহাতে কি যে লাভ হইবে তাহা কেহই বোঝে না। লোকে পাগল বলিতে লাগিল, তাঁহার স্ত্রী বিরক্ত হইয়া উঠিলেন, বাড়ির লোকে অস্থির হইয়া পড়িল, কিন্তু তাহার সেদিকে ভ্রক্ষেপমাত্র নাই। দুই বৎসর হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর তিনশত মাটিব পেয়ালা গড়িয়া তাহার উপর নানারকম মসলার প্রলেপ দিয়া তিনি চুল্লিতে চড়াইলেন। চুল্লি জুড়াইলে পর দেখা গেল, একটি মাত্র বাসনের গায়ে অতি চমৎকার সাদা পালিশ ধরিয়াছে। তখন প্যালিসির আনন্দ দেখে কে!

 এতদিন পর্যন্ত তিনি চারি ক্রোশ পথ হাঁটিয়া এক ব্যবসায়ীর চুল্লিতে তাঁহার জিনিসগুলা পোড়াইয়া আনিতেন। এখন হইতে তিনি নিজের বাড়িতে একটি চুল্লি বানাইতে সংকল্প করলেন। ইটের পঁজায় ইঁট কিনিয়া তিনি নিজে তাহা বহিয়া অনিতেন এবং আপনার হাতে সাজাইয়া চুল্লি গড়িতেন। তার পর, চুল্লি খাড়া হইলে তিনি অনেক কাঠ ও কয়লা সংগ্রহ করিয়া চুল্লি জ্বালাইলেন এবং একশত মাটির বাসন বসাইয়া তাহাতে মসলা চড়াইলেন—এই মসলা গলিলে পর বাসনে এনামেলের মতো সাদা পালিশ হইবে। কিন্তু মসলা আর গলিতে চায় না। সারারাত কাটিয়া গেল, তার পর দিন গেল রাত গেল, এমনি করিয়া ছয়দিন ছয়রাত্র চুল্লির পাশে বসিয়া বৃথায় কাঠিল। তখন প্যালিসি নুতন মসলা বানাইয়া আবার আগুন চড়াইলেন। প্যাসিসির

নানা নিবন্ধ
১৮১