পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 মরুভূমির কথা বলিতে গেলেই উটের কথা আসিয়া পড়ে। উটের শরীরটিকে মরুভূমির উপযোগী করিয়াই গড়া হইয়াছে। চ্যাটাল চ্যাটাল পা, তার আষ্টেপৃষ্টে কড়ায় ঢাকা-ঝামা দিয়া ঘসিলেও তাহাতে ফোস্কা পড়ে না। ক্ষুধা নাই, তৃষ্ণা নাই—এক পেট ঘাস খাইয়া তিন দিন উপোস থাকে—এক ঢোক জল লইয়া সারাদিন পথ চলে। সবদিকে তার সবই ভালো-মন্দের মধ্যে কেবল তার মেজাজটি। আরবদের বিশ্বাস যে উট যদি একবার রাগ করে তবে একদিন হউক, এক বৎসর হউক, সে প্রতিহিংসা না লইয়া ছাড়িবে না। সেইজন্য কোনো উটের মেজাজ বিগড়াইতে দেখিলেই তাহার মাটির উপর নানারকম পোশাক ছড়াইয়া উটকে তাহার মধ্যে ছাড়িয়া দেয়। উট তখন ঐগুলার উপর মনের সুখে লাথি চাঁটি মারিয়া মেজাজ ঠাণ্ডা করে।

 মরুর দেশের কথা বলিলাম। এখন মরু সাগরের (Dead Sea) কথা বলিয়া শেষ করি। মরু সাগরটি একটা মাঝারি গোছের হ্রদ-পঞ্চাশ মাইল লম্বা, আট-দশ মাইল চওড়া। কিন্তু তার মধ্যে কোথাও একটি মাছ বা কোনোরকম জলের প্রাণী নাই। সমুদ্রের জলকে শুকাইয়া ঘন করিলে যেরূপ হয়, মরু সাগরের অবস্থা ঠিক সেইরূপ। জল এমন ভারি যে তাহার মধ্যে ডুবিয়া মরিবার ভয় নাই আর এমন লবণাক্ত যে জলে স্নান করিলে সর্বাঙ্গে চাপ বাঁধিয়া নুন জমিতে থাকে।

সন্দেশ জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৪


যুদ্ধের আলো

 সেকালে অর্থাৎ পুরাণে যে কালের কথা বলা হয় সেই কালে লড়াইটা হত দিনের বেলায়। ভীষ্মপর্বে দশ দিন ধরে লড়াই হল। প্রতিদিনই দেখি সন্ধ্যা না হতেই শখধ্বনি করে যুদ্ধ থেমে গেল, তার পর যে যার মতো শিবিরে ফিরে গেল। এইরকম দিনেরবেলা লড়াই করে রাত্রে সবাই নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করত। কিন্তু অজিকালকার যুদ্ধে এরকম হবার জো নেই। এখন কি দিন কি রাত, কোনো সময়েই নিশ্চিন্ত থাকা সম্ভব নয়। শত্রু যে কখন কোন সুযোগে ঘাড়ে এসে পড়বে, তার জন্য সর্বদা সজাগ থাকতে হয় সৈন্যেরা যুদ্ধ থামিয়ে সবাই মিলে অস্ত্রশস্ত্র গুটিয়ে শিবিরে ফিরে গেল, এরকমটি কোনো সময়েই হতে পারে না। কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রে সব সময়েই সৈন্য হাজির রাখতে হয়।

 কামানেরও বিশ্রাম নেই। রাত্রের অন্ধকারে ঝড়ে বাদলে যখন তখন সে হুংকার দিয়ে উঠছে। তার চোখে দেখবার দরকার হয় না, কেবল ম্যাপ দেখে অঙ্ক কষে হিসাব করে সে গোলা ছুড়ছে। দিনেরাতে কোনো সময়েই শত্রুকে নিশ্চিন্ত থাকতে দেয় না। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যরা খাদ কেটে তারই মধ্যে হয়তো খোলা ময়দানে কত রাত কাটাচ্ছে। সেখানে সারারাত ধরে কড়া পাহারা বসান আছে—কোনোখানে টু শব্দটি হলেই তারা কান খাড়া করে শোনে। কোথাও কোনো ভয়ের কারণ দেখলেই ঘণ্টা বাজিয়ে সকলকে সতর্ক করে দেয়—আর আকাশে তারাবাজি ছুটিয়ে চারদিক আলো করে দেখে, শত্রু আসছে কি না।

নানা নিবন্ধ
১৮৯