পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/১৯৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 যেমন ডাঙায় তেমনি জলে-আবার আকাশেও তেমনি। কোথাও দিনের অপেক্ষায় কেউ বসে থাকে না। কত যুদ্ধের জাহাজ সারারাত সমুদ্রের মধ্যে হাঁ হাঁ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার ‘Search light'-এর ঝকঝকে আলো খড়্গের মতো অন্ধকার কেটে চারিদিক খুঁজে বেড়াচ্ছে। সেই আলো যেখানে পড়ে সেখানে যেন একেবারে রাতকে দিন করে ফেলে। সেই আলোর মুখে যদি কোনো শক্রজাহাজ পড়ে তবে তার আর লকোবার জো নাই। সে যেদিকে যাবে, আলো তার পিছন পিছন ঘুরবে। আর সেই আলোতে পরখ করে যুদ্ধজাহাজ তার উপর কামান দাগবে। তখন তার প্রাণভয়ে পালানো ছাড়া আর উপায় নেই। অন্ধকার রাত্রে জার্মানদের বোমাওয়ালা ‘জেপেলিন' বেলনগুলো যখন আকাশ বেয়ে চোরের মতো আসতে থাকে তখন তার সাড়া পেলেই অমনি বড়ো-বড়ো আলোর ঝাপটা চারিদিকে ছুটে বেরোয়-আকাশ হাতড়ে খুঁজবার জন্য। যুদ্ধের সময় আলোর ব্যবহারটা যতই ভয়ানক হোক-না কেন, তামাশা হিসাবে আলোটা দেখতে ভারি সুন্দর। বড়ো-বড়ো দরকারি ব্যাপারের সময় দশ-বিশটা জাহাজ একসঙ্গে মিলে যখন আলোর খেলা দেখাতে থাকে তখন সে এক চমৎকার দৃশ্য হয়।

 কিন্তু জাঁকাল ব্যাপারের কথা যদি বলো তবে রাত্রে ডাঙায় লড়াইয়ের সময় যে আলোর খেলা চলে, তার আর তুলনা হয় না। চারিদিকে হাজার হাজার কামান আর বন্দুক, তাদের মুখে মুখে লাল আগুন ঝিকমিক করে উঠছে। থেকে থেকে রঙ-বেরঙের তারাবাজি ছুঁড়ে নানারকম সংকেত চলছে। মনে কর, জার্মান খাদের উপর তারা ফুটছে—সাদা লাল, সাদা লাল—তার মানে, ‘শত্রু সৈন্য এদিকে আসছে-কামান চালাও। খানিক পরে হয়তো দেখবে, লাল সবুজ লাল সবুজ লাল সবুজ-জার্মানরা বলছে, “আমরা কোণঠাসা হয়েছি—শীঘ্র উদ্ধার কর। মাঝে মাঝে এক-একটা বড়ো-বড়ো ‘ফানুষ তারা' আস্তে আস্তে জ্বলতে জ্বলতে চারিদিক আলো করে মাটিতে পড়ছে—সেই আলোতে লড়াই আবার জমে উঠছে। হয়তো আশেপাশে ভাঙাচোরা গ্রামগুলোতে আগুন ধরে একএকদিকে আকাশের গায়ে লাল হয়ে উঠেছে। তার উপর থেকে থেকে শত্রুদের চোখ ধাঁধিয়ে বিদ্যুতের আলোর মতো ‘সার্চ লাইট’ এসে পড়েছে। উপরে নীচে চারিদিকে বড়ো-বড়ো গোলা ফাটছে—এক মুহর্ত আলোর ঝিলিক্, তার পর পাহাড় প্রমাণ ধোঁয়া। আলোয় আঁধারে ছায়ায় ধোঁয়ায় মিলে কি ভীষণ তামাশা!

সন্দেশ–আষাঢ়, ১৩২৪


প্রলয়ের ভয়

 পুরাণে আমরা প্রলয়ের কথা পড়েছি। কবে প্রলয় হয়েছিল, আবার কবে হবে, কেমন করে প্রলয় হয়, এই-সবের নানারকম বর্ণনাও তাতে আছে। প্রলয়ের সময়ে সমস্ত সৃষ্টি যে জলে ডুবে যাবে এ কথাও বার বার করে বলা হয়েছে। আশ্চর্য এই যে, নানান দেশে নানান জাতির ইতিহাসে প্রলয়ের প্রায় একই ধরনের বর্ণনা আছে। অন্তত

১৯০
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২