পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২০২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বাতাস বের করে সেই ফঁকা বোতলের মধ্যে বিদ্যুৎ চালিয়ে আকাশ আলেয়ার নকল করতে পেরেছেন। কিন্তু একটা বোতলের মধ্যে আলোর তামাশা আর খোলা আকাশের প্রকাণ্ড শরীরে আলোর খেয়াল-খেলা, এ দুয়ের মধ্যে অনেক তফাত।

সন্দেশ-আশ্বিন, ১৩২৪


আষাঢ়ে জ্যোতিষ

 মানুষের বিদ্যায় যেখানে কুলায় না, কল্পনা সেখানের অভাব পুরাইয়া লয়। প্রাচীন কালের মানুষ যাহারা চন্দ্র সূর্য মেঘ বৃষ্টি আগুন বিদ্যুৎ দেখিয়া অবাক হইত অথচ কোনো ঘটনার কারণ খুঁজিয়া পাইত না, কোনো কিছুর মর্ম বুঝিত না, তাহারাও এই-সব ব্যাপার সম্বন্ধে নানারকম কল্পনা করিতে ছাড়ে নাই। সেই-সব প্রাচীনকালের কল্পনা কিন্তু কত দেশের কত পুরাণে কত গল্পের আকারে এখনো খুঁজিয়া পাওয়া যায়। কেমন করিয়া সৃষ্টি হইল, তাহার কতরকম কাহিনী লোকের মুখে মুখে চলিয়া আসিতেছে, আজও তাহা শুনিলে আমাদের কৌতূহল জাগে। নানান দেশের নানান কাহিনীর মধ্যে সত্য ঘটনা আর কল্পিত কাহিনী এমনভাবে জড়ানো আছে যে, তার কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যা তাহা ঠিক করাই কঠিন।

 এই পৃথিবীর সম্বন্ধেই কত গল্প মানুষে বানাইয়াছে। আমাদের দেশেই এক-এক পুরাণে তার এক-একরকম ঘটনা। এই পৃথিবীকে শূন্যে রাখিবার জন্য বাসুকীর মাথায় তাহাকে বসানো হইল, আবার তাহাতেও লোকের মন ওঠে নাই—মানুষ ক্ষীর সমুদ্রে কচ্ছপের কল্পনা করিয়া সেই কচ্ছপের পিঠে হাতি, হাতির পিঠে বাসুকীসুদ্ধ পৃথিবীকে চাপাইয়াছে। গ্রীস দেশের পুরাণে পৃথিবীটাকে পাতলা চাকতির মতো কল্পনা করা হইয়াছে। সেই অদ্ভুত চাকতি টুকরা টুকরা হইয়া সমুদ্রের মধ্যে ছড়ানো রহিয়াছে-সেই সমুদ্রের আর শেষ নাই, কূলকিনারা কোথাও নাই। কোনো-কোনো দেশে এই জগৎটাকে একটা ঢাকনি-দেওয়া সরার মতো মনে করা হইত। চন্দ্র সূর্যসুদ্ধ আকাশটা ঢাকনি আর পৃথিবীটা সরা। এই পৃথিবীর চেহারার বর্ণনাই কি কম পাওয়া যায়? তিন কোনা, চার কোনা, টাকার মতো, বাটির মতো, পদ্মের মতো, কতরকমের কল্পনা।

 নরওয়ে দেশের পুরাণে বলে এই পৃথিবীটা একটা দৈত্যের মৃতদেহ। পৃথিবীর স্থলের ভাগ তার মাংস, এই সমুদ্রগুলি তার রক্ত, পাহাড়গুলি তার হাড় আর দাঁত আর গাছপালা সব তার গায়ের লোম আর চুলের জটা। সৃষ্টির আদিকাল হইতে অন্ধকার আর শীতের দৈত্যগুলীর সঙ্গে আগুন ও আলোর দেবতাদের লড়াই লাগিয়া আছে। দৈত্যযোদ্ধা ঈমিরকে রথ করিয়া দেবতারা তার শরীরটাকে আকাশের একটা প্রকাণ্ড ফাঁকের মধ্যে গুঁজিয়া সেইখানে এই পৃথিবীর সৃষ্টি করিলেন। মনের মতো পৃথিবী গড়িয়া তাঁহার দৈত্যের মাথার খুলিটা দিয়া আকাশ বানাইলেন, সেই অকাশে দৈত্যের মগজ ছিটাইয়া মেঘের সৃষ্টি হইল। তখন সকলে বলিলেন, এমন সুন্দর পৃথিবী, ইহাকে অন্ধকার রাখা

নানা নিবন্ধ
১৯৭