পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পাখি এসে ফলের বীজ ফেলে গেছে, সুবিধা পেয়ে সেই বীজ এখন ডালপালা মেলে, মাটি পর্যন্ত শিকড় ঝুলিয়ে প্রকাণ্ড গাছ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে নীচের গাছটার খুবই আপত্তি থাকবার কথা, কিন্তু আপত্তি থাকলেই-বা শোনে কে? যেখানে সেখানে জন্ম নিয়ে বেড়ে ওঠায় এক-একটি গাছের বেশ একটু বাহাদুরি দেখা যায়। আমাদের দেশের অশ্বথগাছ এ বিষয়ে একেবারে পাকা ওস্তাদ। ছাতে দালানে পোড়ো মন্দিরে অন্য গাছের ঘাড়ে কারখানায় চিমনির চূড়ায়, যেখানে তাকে সুযোগ দেবে সেখানেই সে মাথা উঁচিয়ে বেড়ে উঠবে। বটগাছের জন্মও অনেক সময়ে অন্য গাছের ঘাড়ের উপর হয়—সেইখানে বাড়তে বাড়তে সে যখন বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয় তখন নীচের গাছটিকে সে অল্পে-অল্পে ফাঁস দিয়ে চেপে মারে। এইরকম করে সে বড়ো-বড়ো তালগাছকেও কাবু করে ফেলতে পারে।

 আর একদল গাছ আছে তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সব সময় তৈরি থাকে, পাছে কেউ তাদের অনিষ্ট করে। শুকনা বালির দেশে মনসাগাছের বাড়তি খুব বেশি। মনসা গাছের পুরু ছাল, তার মধ্যে জলভরা নরমশাঁস, তাতে ক্ষুধাও মেটে তৃষ্ণাও দূর হয়। কিন্তু মনসাগাছের গা-ভরা কাঁটা, জানোয়রের সাধ্য কি তার কাছে ঘেঁষে। গোরু ছাগলে কত সময়ে ক্ষুধার তাড়ায় কাঁটার কথা ভুলে গিয়ে মনসাগাছে মুখ দিতে গিয়ে নাকে মুখে কাঁটার খোঁচা খেয়ে রক্তাক্ত হয়ে পালিয়ে আসে। মনসা জাতীয় গাছ নানারকমের হয়, কোনটা ছোটোখাটো, তার পুরু পুরু চ্যাটাল পাতা, কোনোটার পাতা নেই একেবারে থামের মতো খাড়া, কোনোটার চেহারা ঝোপের মতো, কোনোটার ভুট্টার মতো, কোনোটা চল্লিশ হাত লম্বা, কোনোটা বড়ো জোর এক হাত কি দেড় হাত। কিন্তু এক বিষয়ে সবাই সমান, সকলের গায়ে শজারুর মতো কাটা। কোনোটার কদমফুলের মতো সুন্দর চেহারা, দেখে হাত দিতে ইচ্ছে হয়—কিন্তু একটিবার হাত দিলেই বুঝবে কেমন মজা।

 এই গাছগুলার কাঁটা এক-এক সময়ে এমন সরু হয় যে, হঠাৎ দেখলে বোঝা যায় না-কিন্তু ধরতে গেলে একেবারে ঝাঁকে ঝাঁকে কাঁটা চামড়ার মধ্যে ফুটে যায়। কাঁটাওয়ালা গাছ নানারকমের আছে, তার মধ্যে কোনো কোনোটি শুধু কাঁটাতেই সন্তুষ্ট নয়, তারা কাঁটার মধ্যে বিষ ভরে রাখে। তাতে কাঁটার খোঁচা অরি বিষের জ্বালা দুটোই বেশ একসঙ্গে টের পাওয়া যায়। আবার দু-একটার কাঁটা নিতান্তই সামান্য—সরু শুঁয়ার মতো কিন্তু তাদের বিষ বড়ো তেজালো। বিছুটির পাতা অণুবীক্ষণ দিয়ে দেখলে মনে হয় যেন অসংখ্য হূল উঁচিয়ে আছে-তাতে হাত দিবামায় তার আগাটুকু ভেঙে গিয়ে ভিতর থেকে বিষাক্ত রস বেরিয়ে আসে। এক-এক জাতীয় বিছুটি আছে তাদের বিষে অসহ্যরকম যন্ত্রণা হয় এবং সপ্তাহ ভরে তার জের চলে। এক সাহেব একবার এইরকম এক বিছুটি ঘাঁটতে গিয়ে তার পর নয় দিন শয্যাগত ছিলেন। তিনি বলেছেন যে বিহুটি লাগবার পর সারাদিন তাঁর মনে হত যেন তপ্ত লোহা দিয়ে কে তাঁর হাতের মধ্যে ঘা মারছে।

 ‘ওল খেয়ো না ধরবে গলা’–এ কথা আমিও জানি তোমরাও জান; কিন্তু জঙ্গলের ধারে যখন বুনো ওলের নধর সবুজ পাতাগুলো ছড়িয়ে থাকে, তা খেলে যে গলা ধরবে এ কথা গোরু ছাগলে কি করে জানবে? এই-সব পাতার মধ্যে ছুঁচের চাইতেও সরু অতি

নানা নিবন্ধ
২০৩