পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২১৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাহার কথা তোমরা অনেকে হয়তো শুনিয়াছ-তাহার নাম “রঞ্জনের আলো বা X-Ray (অজানা আলো)। ফাঁকা বোতলের মধ্যে বিদ্যুতের আঘাতে এই আশ্চর্য আলোর জন্ম হয়। কাঁচ ফুড়িয়া সেই আলো বাহিরে চলিয়া অসে, কিন্তু তাহাকে চোখে দেখা যায় না।

 কোনো কোনো জিনিস আছে, তাহারা নানারকম তেজ শুষিয়া সেই তেজে অবার আপনি আলো দিতে থাকে। একরকম পাথর দেখা যায়, তাহারা দিনের আলোক জমাইয়া রাখে আর অন্ধকারে জ্বল্জ্বল্‌ করে। রাত্রে সময় দেখিবার জন্য আজকাল একরকম ঘড়ি কিনিতে পাওয়া যায়, তাহার কাঁটা ও সময়ের অঙ্কগুলা আপনার আলোয় টিম্‌টিম্ করিয়া জ্বলিতে থাকে। আজকাল যুদ্ধেও এইরূপ মসলা-মাখানো একপ্রকার রঙের ব্যবহার হয়। যেখানে শত্রুর ভয়ে ভালোরকম আলো জ্বালিবার উপায় নাই সেখানে এই জ্বলন্ত রঙের চিহ্ন আঁকিয়া নানারকম সংকেত জানানো হয়, অন্ধকারে পথ দেখাইয়া চলাফেরার সুবিধা করা হয়।

 ফাঁকা বোতলের ঐ অদৃশ্য তেজ ধরিবার জন্যও নানারকম মসলা পাওয়া যায়। একটা পর্দার উপর সেই মসলা মাখাইয়া তাহাকে ঐ বিদ্যুৎ-পোর বোতলের কাছে অনিলেই পর্দাটা আলো হইয়া ওঠে। বোতলটাকে কালো কাগজে মুড়িয়া ফেল, তবুও পর্দা জ্বলিতে থাকিবে। বোতলের উপর কাঠের বাক্স চাপা দেও-কাঠ ভেদ করিয়া সে অদৃশ্য আলো মসলার পর্দাকে জ্বালাইয়া তুলিবে। কিন্তু বিদ্যুৎ চালানো একটিবার বন্ধ করিয়া বোতলের তেজ নিভাইয়া দাও, সেই সঙ্গে পর্দার আলো নিভিয়া যাইবে। পর্দার সামনে একখানা লোহার টুকরা ধর, তাহা হইলেও যেখানে লোহার আড়াল পড়িয়াছে সেইখানে পর্দা জ্বলিবে না—কারণ বোতলের আলো লোহার ভিতর দিয়া যাইতে পারে না। একটা পয়সা আনিয়া পর্দার সামনে ধর, তাহারও পরিষ্কার গোল ছায়া পড়িবে। এইরকম পরীক্ষা করিলে দেখা যায় যে, পর্দার উপর হাড়ের ছায়া পড়ে কিন্তু মাংস বা চামড়ার কোনো ছায়া পড়ে না।

 এইজন্য পর্দার সামনে তোমার জামাসুদ্ধ হাতখানা ধরিলে তোমার জামাও দেখিবে না আর নধরপুষ্ট মাংস-ভরাট আঙুলও দেখিবে না—দেখিবে কতগুলো হাড়ের ছায়া।

 একটি কাঠবিড়ালের ছবি তোল। হবিতে হাড়গোড় সবই উঠিবে—অথচ অমন জমকাল ল্যাজটির চিহ্নমাত্র থাকিবে না। জ্যান্ত জীবের এরকম কংকালছায়া সর্বপ্রথম দেখেন রঞ্জেন বা রণ্ট্‌গেন সাহেব (Rontgen), তিনিই ১৮৯৬ খৃস্টাব্দে, অর্থাৎ বাইশ বৎসর আগে ঐরূপ জ্বলন্ত পর্দার সাহায্যে এই আলো আবিষ্কার করেন। প্রথম যখন তিনি পর্দার সামনে হাতের আড়াল দিয়া দেখেন তখন তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নাই যে কতগুলা হাড়ের ছায়া দেখিবেন। তাই হঠাৎ আপনার ‘হাড্ডিসার’ ছায়া দেখিয়া তিনি ভারি আশ্চর্যবোধ করিয়াছিলেন।

 তামাশা হিসাবেও এটা একটা দেখিবার মতো ব্যাপার, তাহাতে আর সন্দেহ কি? কাঠের বাক্সের মধ্যে চামড়ার ব্যাগ, কাগজ কলম, হাড়ের বোতাম, ছুচসূতা, চাবি ভরিয়া একবার পর্দার আলোর সামনে ধর—কাঠের বাক্স ছায়াতে কাঁচের মতো স্বচ্ছ দেখাইবে আর তাহার ভিতরকার ছুঁচ চাবি আর কলমের মুখটা স্পষ্ট হইয়া ধরা পড়িবে।

নানা নিবন্ধ
২০৯