পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

জল দাঁড়াইবার উপায় ছিল না। বৃষ্টিধারা ডাঙায় নামিবামাত্র টগ্‌বগ্ করিয়া ফুটিয়া উঠিত এবং চারিদিক গরম ধোঁয়ায় ঢাকিয়া আকাশের জিনিস আকাশেই ফিরিয়া যাইত। তখন দেখিবার কেহ ছিল না, শুনিবার কেহ ছিল না; ফুটন্ত বৃষ্টিধারার অবিশ্রাম গর্জনের মধ্যে ধোঁয়ায় ভরা আকাশ যখন পৃথিবীর উপর ঘনঘন বিদ্যুতের চাবুক মারিত তখনকার সে ভয়ংকর দৃশ্য কল্পনা করাও সহজ কথা নয়।

 তাহারও পূর্বে এক সময়ে পৃথিবীটা প্রকাণ্ড আগুনের পিণ্ডমাত্র ছিল। তখন তাহার শরীরটি ছিল এখনকার চাইতে প্রায় লক্ষগুণ বড়ো। বেশ একটি ছোটোখাটো সূর্যের মতো সে আপনার প্রচণ্ড তেজে আপনি ধক্‌ধক্ করিয়া জ্বলিত। তাহারও পূর্বেকার অবস্থা কেমন ছিল, সে কথা পণ্ডিতেরা আলোচনা করিয়াছেন। যাহা হউক, মোট কথা এই যে, পৃথিবীর বয়স অনেক হইয়াছে। মানুষের বয়স বাড়িয়া যখন সে বৃদ্ধ হইতে চলে তখন তাহার শরীরের তেজ কমিয়া যায়, গায়ের রক্ত ঠাণ্ডা হইয়া আসে। পৃথিবীর এটা কোন বয়স? সে কি এখন প্রৌঢ় বয়স পার হইতেছে? ভাবিবার কথা বটে। পৃথিবীর শেষ বয়সটা কিরকম হইবে, তাহার পক্ষে বার্ধক্যই-বা কি আর মৃত্যুই-বা কি, তাহার বিচার করা দরকার।

 মানুষের মরিবার নানারকম উপায় আছে। কেহ অল্পে অল্পে বৃদ্ধ হইয়া মরে কেহবা তাহার পূর্বেই মরে, কেহ বহুদিন রোগে ভুগিয়া মরে, কেহ দুর্ঘটনায় হঠাৎ মরে। পৃথিবীর বেলায় মৃত্যুটা কিরকমে ঘটিবে তাহা কে জানে? যদি বৃদ্ধ হইয়া পৃথিবীকে অল্পে অল্পেই মরিতে হয় তবে কোন অবস্থাকে তাহার মৃত্যুর অবস্থা বলিব? যখন জীবজন্তু থাকিবে না, মেঘ বাতাস থাকিবে না, নদী সমুদ্র থাকিবে না, পথিবী শুকাইয়া চাঁদের মতো কংকালসার হইয়া পড়িবে তখন বলা যাইবে ‘পৃথিবীটা মরিয়াছে'। সেরকম হইবার কোনো লক্ষণ দেখা যায় কি? যায় বৈকি! পৃথিবী যখন শূন্যে ছুটিয়া চলে তখন সে বাতাসটাকেও তাহার সঙ্গে সঙ্গে লইয়া চলে বটে, কিন্তু তবু কিছু বাতাস চারিদিকে ছিটাইয়া পড়ে তাহা শূন্যে উড়িয়া যায় যার পৃথিবীতে ফিরিয়া আসে না। সেই বাতাসের মধ্যে যেটুকু জল বাষ্প হইয়া থাকে তাহাও এইরপে আকাশে ছড়াইয়া পড়ে। এইভাবে যাহা নষ্ট হয় তাহার পরিমাণ খুবই সামান্য; কিন্তু সামান্য লোকসানও যদি ক্রমাগত লক্ষ লক্ষ বৎসর চলিতে থাকে তবে শেষে তাহার হিসাবটা খুবই মারাত্মক হইয়া পড়ে। নদী ও সমু্দ্রের মধ্যে যে জল আছে ডাঙার মাটি তাহাকে প্রতিদিনই অল্পে অল্পে শুষিয়া লইতেছে এবং তাহাতেও জলটা দিন দিনই কমিয়া আসিতেছে; সুতরাং আজ না হউক, হাজার বছরে না হউক, জল বাতাস সব একদিন শেষ হইবেই। তখন মেঘ থাকিবে না, কুয়াশা থাকিবে না, রামধনুকের শোভা, উদয়াস্তের রঙের খেলা কিছুই থাকিবে না কেবল নিস্তব্ধ নির্জন “মশানের মতো গথিবীর মৃত কংকাল পড়িয়া থাকিবে।

 কিন্তু দিনের পর রাত, রাতের পর দিন, এই যে আলো আঁধারের অবিশ্রাম খেলা, ইহাও কি চিরকাল থাকিবে না? না, তাহাও থাকিবে না। মোটামুটি আমরা যে দিনরাতের হিসাব ধরি সেই দিনরাতের হিসাবও ক্রমেই বাড়িয়া চলিতেছে। জোয়ার ভাঁটার আঘাত পৃথিবীকে প্রতিদিনই সহিতে হয়, জলের সঙ্গে ডাঙার ঘষাঘষি প্রতিদিনই বাধিয়া থাকে; তাহার ফলে, পৃথিবীর ঘোরপাকের বেগ ক্রমেই ঢিলা হইয়া পড়িতেছে। পাঁচলক্ষ

২৩৬
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২