পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 তেমন একটা তারা যদি আসে তবে সে সূর্যের রাজ্যের সীমানায় আসিবার পূর্বেই নেপচুন প্রভৃতি বহু দূরের গ্রহগুলির চালচলন বিগড়াইতে আরম্ভ করিবে। পণ্ডিতেরা ব্যস্ত হইয়া হিসাব করিতে বসিবেন, উপদ্রবটা কত বড়ো, কত দূরে এবং কোনদিকে। সূর্যের আলোয় সেই অন্ধকার তারা ক্রমে স্পষ্ট হইয়া উঠিবে, ক্রমে সে সৌরজগতের ভিতরে আসিয়া পড়িবে। ততদিনে বড়ো-বড়ো গ্রহেরা পর্যন্ত তাহাদের বহুদিনের অভ্যস্ত চাল ভলিয়া বেচাল চলিতে আরম্ভ করিবে। একদিকে সুর্য আর একদিকে নুতন অতিথি, এই দোটানায় পড়িয়া পৃথিবী টলমল করিতে থাকিবে। জোয়ারের বিপুল টানে নদীর জল ফুলিয়া উঠিবে, সাগরের তরঙ্গ ভীষণ বেগে পৃথিবীর উপর ছুটিয়া পড়িবে, ভূমিকম্পে পাহাড় পর্বত ধ্বসিয়া পড়িবে, বহুদিনের ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি আবার জাগিয়া সহস্র মুখে আগুন ফুঁকিতে থাকিবে। আর জীবজন্তুর হাহাকার ডুবাইয়া ঝড়ের বাতাস পাগলের মতো ছুটিয়া ফিরিবে। তার পর যখন সূর্যে তারায় সংঘর্ষ বাধিবে তখনকার অবস্থা কল্পনা করাও অসম্ভব। মুহর্তের মধ্যে এক সূর্য কোটি সূর্যের তেজ ধারণ করিবে, সূর্যের আগুন অসম্ভব বেগে সমস্ত গ্রহ চন্দ্র পৃথিবীকে গ্রাস করিয়া ফেলিবে। আবার সেই আদিকালের নীহারিকার মতো জ্বলন্ত বাষ্পের আগুন সমস্ত সৌরজগতের আকাশ জুড়িয়া জ্বলিতে থাকিবে। তার পর কত যুগযুগান্তর পরে তাহার ভিতর হইতে আবার নূতন সূর্য বাহির হইয়া নূতন উৎসাহে নূতন সংসার পাতিয়া বসিবে। এ পৃথিবী তখন না থাকুক, আবার নূতন পৃথিবীর সৃষ্টি হওয়াইবা বিচিত্র কি?

 ইহার মধ্যে অসম্ভব কিছুই নাই। সেদিন যে হঠাৎ নতন তারা দেখা গিয়াছিল, তাহাও সুদূর আকাশে এইরূপ কোনো দুর্ঘটনার সামান্য একটু নমুনা মাত্র। আমাদের এই ছোটো জগৎটুকুর মধ্যে যদি তেমন কোনো প্রলয় আসিয়া পড়ে, তবে বিপদের সম্ভাবনা বুঝিবার পর সমস্ত শেষ হইতে প্রায় পঞ্চাশ বৎসর সময় লাগিবে। সুতরাং অন্তত আরো চল্লিশটা বছর তোমরা সকলেই খুব নিশ্চিন্তে থাকিতে পার।

সন্দেশ-মাঘ, ১৩২৬


নৌকা

 আমি একজন ছেলের কথা জানিতাম, সে কখনো নৌকা দেখে নাই। ইংরাজি বইয়ে সে ছবি দেখিয়াছিল এবং নৌকা যে জলে ভাসে এটুকুও তাহার জানা ছিল। কিন্তু সত্যিকারের নৌকা কখনো সে চোখে দেখে নাই। আশা করি সন্দেশের পাঠক-পাঠিকাদের এমন কেউ নাই যাহাকে, নৌকা জিনিসটা কিরূপ, তাহা বুঝাইয়া বলা দরকার। এই আমাদের দেশেই নদী নালায় খালে বিলে কত রকম-বেরকম নৌকা দেখা যায়। ভারী ভারী বজরা, ছোটোছোটো ডিঙি, লম্বা লম্বা ছিপ্-এক-একটা এক-এক রকম।

 গাড়ি তৈয়ারি করিবার আগেই বোধ হয় মানুষ নৌকা তৈয়ারি করিতে শিখিয়াছিল। এখনো অনেক অসভ্য জাত দেখা যায়, তাহারা গাড়ি ঘোড়ার ব্যবহার জানে না কিন্তু নৌকা

২৩৮
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২