পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

জলেতে, খুঁজিতে গেলে সর্বত্রই লোহা পাওয়া যায়। অথচ এক সময়ে লোকে লোহার ব্যবহার জানিত না, লোহা তৈয়ারি করিতে পারিত না। জল লাগিয়ে লোহায় মরিচা ধরিয়া যায়। লোহাধাতু আর লোহার মরিচা, দুটা এক জিনিস নয়। কিন্তু মরিচা বা 'লৌহমল’ নানারকমে ‘শোধন’ করিয়া তাহা হইতে আবার খাটি লোহা বাহির করা যায়। যে-মস্ত খনিজ জিনিস হইতে লোহা তৈয়ারি করা হয়, সেগুলিও এইরকম মরিচা-জাতীয় জিনিস, অনেক হাঙ্গামা করিয়া তাহাদের শোধন না করিলে তাহা হইতে লোহা বাহির হয় না। সোনা রূপা ও তামা অনেক সময়ে খাঁটি ধাতুর আকারেও পাওয়া যায় এবং খনিজ তাবস্থায় তাহাদের শোধনও লোহার চাইতে অনেক সহজ। সেইজন্য তামা প্রভৃতি ধাতুর ব্যবহার শিখিবার পরেও মানুষে অনেকদিন পর্যন্ত লোহা বানাইবার কৌশল বাহির করিতে পারে নাই।

 একবার যদি কোথাও কোনো লোহা বানাইবার কারখানায় যাও, তাহা হইলে বুঝিতে পারিবে যে লোহার মতো সামান্য জিনিসের জন্যও যানুষকে কতখানি চিন্তা পরিশ্রম ও হাঙ্গামা ফরিত হয়। আমাদের দেশে সাক্‌চিতে টাটা কোম্পানির লোহার কারখানা আছে-সেখানে প্রতি বৎসর হাজার হাজার মণ লোহা আর পাত তৈরি হয়। প্রকাণ্ড চিমনির মতো বড়ো-বড়ো পাথরের চুল্লি, তাহার মধ্যে সারাদিন সারারাত আগুনের আর বিশ্রাম নাই। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, রাবণের চিতার মতো সে আগুন জলিতে থাকে। একবার আগুন নিভিয়া গেলেই হাজার হাজার টাকার চুল্লি ফাটিয়া চৌচির হইয়া যাইবে। তাই দিনরাত সেখানে কাজ চলিতেছে, চিমনির মুখ দিয়া আগুনের লাল জিভ সারক্ষণ আকাশকে রাঙাইয়া তুলিতেছে। মাঝে মাঝে চুল্লির ঢাকনি খুলিয়া, গাড়ি-বোঝাই কয়লা-মিশানো লৌহখনিজের মসলা চুল্লির মধ্যে ঢালিয়া দেয়-একেবারে বিশত্রিশ বা একশো-দুশো মণ। চুল্লির মধ্যে সেই-সমস্ত মসলা গলিয়া পুড়িয়া তরল লোহা হইয়া জমিতে থাকে। মাঝে মাঝে চুল্লির নর্দমা দিয়া লোহার ময়লা ‘গাদ' বাহির করিয়া দিতে হয়। দরকার মতো শোধন হইলে পর পাশের একটা নল খুনিয়া তরল লোহা ঢালিয়া ফেলিতে হয়।

 পৃথিবীতে যত লোহার কারখানা আছে, তাহাতে প্রতি বৎসর তিনশো কোটি মণ লোহা তৈয়ার হয়। এবং বছর বছর ইহার পরিমাণ বাড়িয়াই চলিয়াছে। লোহা নানারকমের হয়। যে লোহা ঢালাই করিয়া সাধারণত কডি বরগা শিক প্রভৃতি তৈয়ারি হয় আর যে ইস্পাত লোহা ক্ষুর বা তলোয়ারের জন্য ব্যবহার হয়, এ দুয়ের মধ্যে অনেকখানি তফাত। সাধারণ চুল্লির মধ্যে যে লোহা তৈয়ারি হয়, তারা একেবারে খাঁটি লোহা নয়; আমরা যতরকম লোহা সর্বদা ব্যবহার করি, তাহার কোনোটাকেই ঠিক খাঁটি লোহা বলা যায় না। এই-সব লোহার সঙ্গে অল্প বা বেশি পরিমাণে অঙ্গার বা কয়লা, গন্ধক ফস্‌ফরাস প্রভৃতি নানারকম জিনিসের মিশাল থাকে এবং সেই মিশালের জন্য লোহার রূপ গুণ নানারকম হইয়া যায়। কোনোটা নরম, কোনোটা শক্ত, কোনোটা সহজে ঢালাই হয়, কোনোটা বেশ দলিয়া পিটিয়া নানারকম করা যায়, কোনোটা স্প্রিং-এর মতো বাঁকানো যায়, কোনোটা বাঁকাইতে গেলে ভাঙিয়া যায়, কোনোটাকে নানারকমে তাতাইয়া এবং নানা কৌশলে ঠাণ্ডা

২৫০
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২