পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৫৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কিন্তু তার সঙ্গে চুন-পাথর আর ক্ষার মিশিয়ে জ্বাল দিলে সব গলে এক হয়ে যায়, আর ঠাণ্ডা হলে কাঁচ হয়ে জমে থাকে।

 প্রথম প্রথম মানষে যে কাঁচের ব্যবহার করত, সে কেবল শৌখিন জিনিস হিসাবে। কাঁচ তৈরি করবার সময় তার সঙ্গে নানারকম ধাতুর মসলা মিশিয়ে তাতে নানারকম রঙ ফলানো যায়। সেই-সমস্ত রঙিন কাচের পুথিমুক্তো এক সময়ে লোকে অসম্ভব দামে কিনে নিত। বহুমূল্য রত্ন বলে দেশ-বিদেশে তার আদর হত। সে সময়ে কাঁচ তৈরির সংকেত খুব অল্প লোকেই জানত; আর তারা কাউকে সে-সব শেখাত না। কিন্তু তবু দুশো-পাঁচশো বা হাজার বছরে সে-সব গোপন কথাও অল্পে অল্পে ফাঁস হয়ে যেতে লাগল। ক্রমে এশিয়া থেকে ইউরোপের নানা স্থানে এ বিদ্যার চলন হতে লাগল। বুদ্ধিমান রোমানেরা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই কাঁচ তৈরিতে এমন উন্নতি করে ফেলল যে,কয়েকশো বছরের মধ্যেই কাঁচের শার্শী,বাসন, প্রদীপ-দান প্রভৃতি মানুষের অত্যন্ত ধনী লোকদের -নিত্য ব্যবহারের জিনিস হয়ে দাঁড়াল।

 এখন আমরা যে-সমস্ত ঝকঝকে পরিষ্কার কঁচ সদা সর্বদা ব্যবহার করি, তিনশো বছর আগে সেরকম কঁচ তৈরিই হত না। সে সময়কার কাঁচ হত ময়লাগোছের, তার মাঝে মাঝে ঘোলাটে দাগ থাকত। তার উপরেই রঙ ফলিয়ে, কৌশলে তার দাগের সঙ্গে দাগ মিলিয়ে ওস্তাদ কারিকররা আশ্চর্য সুন্দর সব জিনিস গড়ত। কিন্তু নিখুঁত সাদা কাঁচ যে কাকে বলে, সে তারা জানতই না। প্রায় তিনশো বছর আগে ইংলণ্ডের কয়েকজন উৎসাহী লোকের চেষ্টায় একরকম চমৎকার কাঁচ তৈরি হয়, সেই থেকেই কাঁচের ব্যবসার চূড়ান্ত উন্নতির আরম্ভ। তার আগে কাঠের চুল্লিতে কাঁচ তৈরি হত, এই ইংরাজেরাই সকলের আগে কয়লার চুল্লি ব্যবহার করলেন। এরা সমুদ্রের পানা পুড়িয়ে, তা থেকে পটাশ বার করে, সেই পটাশের মধ্যে খাঁটি চকমকি পাথরের গুঁড়ো আর সীসা-ভস্ম মিশিয়ে জলের মতো স্বচ্ছ নূতনরকমের কঁচি তৈরি করলেন। তখন হতে সেই কাঁচের শার্শী, সেই কাঁচের আর্শি, সেই কাঁচের যন্ত্র, বাসন, চশমা, দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। শৌখিন ধনীর শখের কাঁচ সাধারণ লোকের ঘরোয়া জিনিস হয়ে উঠল।

 লোহা না থাকলে মানুষের সভ্যতার শক্তি যেমন খোঁড়া হয়ে যায়, কাঁচ না থাকলে বিজ্ঞানের বুদ্ধিও সেইরকম কানা হয়ে পড়ে। এই তিনশো বছরের মানুষ তার জ্ঞানের পথে যা কিছু উন্নতি ও আবিষ্কার করেছে, কাঁচ না থাকলে তার প্রায় বারো-আনাই অসম্ভব হত। কাঁচ ছিল তাই দুরবীন হতে পেরেছে; কাঁচ ছিল তাই অণুবীক্ষণের জন্ম হয়েছে। আকাশের গ্রহ নক্ষত্রের আশ্চর্য রহস্য, গাছপালা কীটপতঙ্গের গঠন কৌশল, অসংখ্য রোগবীজের সঙ্গে স্বাস্থ্যের নিত্য লড়াই, অতি বড়ো ব্রহ্মাণ্ডের তত্ত্ব আর অতি সুক্ষ অণুপরমাণুর ইতিহাস-এ সমস্তই মানুষ জানতে পারছে কেবল কাচের কৃপায়। গ্রহ নক্ষত্রের আলোক দেখে পণ্ডিতে তার মালমসলার বিচার করেন, তার ভূত-ভবিষ্যৎ কত কি বলেন- তার জন্যও কাঁচের বর্ণবীক্ষণ যন্ত্র চাই। ফোটোগ্রাফার ছবি তোলেন, তার জন্য কাঁচের লেন্স চাই। বৈজ্ঞানিকের ঘরে ঘরে কাঁচের থার্মোমিটার, ব্যারোমিটার, আরো নান রকম কত যন্ত্র আর কত 'মিটার'। মোট কথা, কাঁচের ব্যবহার যদি মানুষে না জানত তবে আজও তার সভ্যতার ইতিহাস অন্তত তিনশো বছর পেছিয়ে থাকত।

২৫২
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২