পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বললেন, “তা হলে চলবে না। আমি হলাম আদি রাজা ‘চীন্- আমার আগে আর কোনো রাজা-টাজার নাম থাকলে চলবে না। এখন থেকে নতুন করে আবার সব ইতিহাস আরম্ভ হবে।”

 এই বলে তিনি হুকুম দিলেন, সেকালের ইতিহাসের যত পুঁথি যেখানে পাও সব খুঁজে এনে পুড়িয়ে ফেল। রাজার হুকুমে চারিদিক থেকে রাশি রাশি হাতের লেখা পুরানো বই জড়ো করে পোড়ানো হল।

 কিন্তু শুধু বই পোড়ালে কি হবে? দেশের যারা পণ্ডিত লোক, তাঁরা তো সে-সব বই পড়েছেন। এতদিন কিরকমভাবে দেশের কাজকর্ম হয়ে এসেছে তাও তারা সব জানেন। রাজার এ-সব খামখেয়াল তাঁরা পছন্দ করবেন কেন? কাজেই আবার হুকুম হল, মারো সব সেকেলে পণ্ডিতদের। অমনি খুঁজে খুঁজে বড়ো-বড়ো পণ্ডিতদের ধরে এনে মেরে ফেলা হল।

 কিন্তু এত কাণ্ড করেও রাজা যেরকম চেয়েছিলেন তেমনটি হল না। রাজা যখন মারা গেলেন তখন দেখা গেল এখানে সেখানে দু-চারটি বুড়ো-বুড়ো পণ্ডিত তখনো বেঁচে আছেন, প্রাচীনকালের কীতিকথা আইনকানুন সব তাদের মুখস্থ। তার পর সেকালের পুঁথিপত্র যা ছিল তাও দেখা গেল সব পোড়ানো হয় নি। এমন-কি, পুরানো একটা বাড়ির ভেতর থেকে আস্ত একটা লাইব্রেরিই বেরিয়ে গেল যার মধ্যে আগেকার রাজারাজড়াদের অনেক কথাই লেখা রয়েছে। সুতরাং, রাজা হোয়াংতি কেবল নামেই আদি রাজা হয়ে রইলেন; মাঝ থেকে খালি কতগুলো বই নষ্ট করাই সার হল, অরি কয়েকশো নিরীহ পণ্ডিত মিছামিছি প্রাণ হারালেন। আর হোয়াংতি রাজার দুর্বুদ্ধির জন্য ইতিহাসে তার দুর্নাম থেকে গেল।

 জবরদস্তি করে রাজামশাই নাম কিনতে গিয়ে ঠকে গেলেন, কিন্তু আর-একদিকে সত্যি সত্যি তিনি এমন একটা কীর্তি রেখে গিয়েছেন যার জন্য আজও তাঁর নাম লোকে মনে করে রেখেছে। সেই কীর্তিটি হচ্ছে চীনদেশের রাজ্য-ঘেরা পাঁচিল। মানুষ যেমন করে তার দালানদুর্গ বা ক্ষেতবাগান দেয়াল দিয়ে আর বেড়া দিয়ে ঘেরে ঠিক তেমনি করে তিনি তার রাজ্যের উত্তর আর পশ্চিম দিকে প্রকাণ্ড পাঁচিলের ঘেরাও দিয়েছিলেন। পুব সীমানার সমুদ্র থেকে উত্তরের পাহাড় পর্যন্ত, পাহাড়ের উপর দিয়ে পশ্চিমের মরুভূমি পর্যন্ত, উঁচুনিচু আঁকাবাঁকা, দেড়হাজার মাইল লম্বা প্রকাণ্ড দেয়াল। এমন আশ্চর্য বড়ো দেয়াল পৃথিবীর আর কোথাও নেই।

 চীন সাম্রাজ্যের মধ্যে যে জায়গাটুকুকে ইংরাজিতে চায়না বলা হয়, সেইটুকু হচ্ছে আসল চীনদেশ। মাঞ্চু আর তাতার জাতীয় দস্যুরা এই চীনদেশের লোকেদের উপর ভারি অত্যাচার করত। থেকে থেকে হঠাৎ দল বেঁধে এসে লোকের টাকাকড়ি ফল শস্য সব লুঠপাট করে তারা পালিয়ে যেত। তাদের ঠেকাবার জন্যই এই প্রকাণ্ড পাঁচিল। ভিতরে মাটির বাঁধ, বাইরে ইট-পাথরের গাঁথুনি, তার মাথার উপর টালিবাঁধানো রাস্তা, পাঁচিলের উপর দিয়ে লোকজন গাড়িঘোড়া সব যাতায়াত করে। এক-এক জায়গায় এমন চওড়া যে পাঁচ-সাতটা উটের গাড়ি অনায়াসে পাশাপাশি চলতে পারে। কোথাও দেয়ালের গায়ে প্রকাণ্ড ফটক, কোথাও সিঁড়ির মতো ধাপকাটা, কোথাও প্রহরীদের প্রকাণ্ড উঁচু পাহারা-ঘর। এমনি

২৬০
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২