পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৭০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বায়োস্কোপ

 ঘরের বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। চেয়ে দেখ, খাড়া খাড়া রেখার মতো বৃষ্টির ধারা পড়ছে। এক-একটি ধারা এক-একটি বৃষ্টির ফোঁটা; কিন্তু ফোটাগুলো মোটেইফোঁটার মতো দেখাচ্ছে না- দেখাচ্ছে ঠিক লম্বা লম্বা আঁচড়ের মতো। একটা দড়ির আগায় একটা পাথর বেঁধে যদি খুব তাড়াতাড়ি ঘোরাতে পার তা হলে দেখতে মনে হবে, যেন আস্ত একটা চাকা ঘুরছে। কিন্তু তা বলে পাথরটা ঘুরবার সময় তো আর সত্যি করে চাকার মতো হয়ে যায় না। তবে এরকম দেখায় কেন?

 অন্ধকার রাত্রে আকাশের গা দিয়ে যখন উল্কা ছুটে যায় তখন তাদেরও দেখায় ঠিক ঐরকম একটানা লম্বা দাগের মতো। উল্কাটা জ্বলতে জ্বলতে যে পথ দিয়ে ছুটে গেল, মনে হয় যেন সেই পথের সমস্তটা বা অনেকখানি এক সঙ্গে জ্বলতে দেখলাম। কিন্তু আমরা জানি, উল্কাটা সত্যি সত্যি একই সময়ে ততখানি লম্বা জায়গা জুড়ে ছিল না। সেটা আগে এখানে, পরে ওখানে, তার পর সেখানে, এমনি করে ক্রমাগত ছুটে চলেছে-কিন্তু সে খুব তাড়াতাড়ি চলছে বলে মনে হয় যেন একই সময়ে তাকে এখানে ওখানে সেখানে দেখতে পাচ্ছি। বৃষ্টির ফোঁটার বেলাও তেমনি হয়। এইমাত্র তাকে দেখছি মাটির থেকে বিশ হাত উঁচুতে; কিন্তু এই দেখাটুকু মন থেকে মুছতে না মুছতে সেই ফোঁটাটা একেবারে মার্টি পর্যন্ত নেমে পড়েছে। তাই মনে হচ্ছে যেন একই সময়ে বিশ হাত উঁচু থেকে মাটি পর্যন্ত সমস্তটা জায়গা জুড়েই ফোঁটাটাকে দেখতে পাচ্ছি।

 এইরকম পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, চোখ দিয়ে আমরা যা দেখি, চোখের দেখা শেষ হলেও তাকে আমাদের মন খানিকক্ষণ পর্যন্ত ধরে রাখে। সে অতি অল্প সময়-এক সেকেণ্ডের পাঁচ ভাগের এক ভাগ, অথবা তার চাইতেও কম।

 মনে কর, একটা ছবির দিকে তুমি তাকিয়ে আছ। আমি মাঝে থেকে তোমার চোখের সামনে আড়াল দিলাম, তুমি আর সে ছবি দেখতে পারছ না। যদি আড়াল সরিয়ে নেই, অমনি আবার দেখতে পাবে। যদি বার বার আড়াল দেই আর বার বার সরাই, তা হলে মনে হবে, ছবিটা বার বার দেখা যাচ্ছে আর বার বার অদৃশ্য হচ্ছে। কিন্তু এই কাজটি যদি খুব তাড়াতাড়ি করতে পারি। অর্থাৎ মনে কর প্রতি সেকেণ্ডে যদি দশবার আড়াল পড়ে আর দশবার দেখতে পাও, তা হলে আর আড়াল-দেওয়া টের পাবে না। মনে হবে আগাগোড়াই স্থিরভাবে ছবিটা দেখতে পাচ্ছি। প্রথম যে ছবি দেখছ, তার জের ফুরোতে না ফুরোতে দ্বিতীয়বারের ছবিটা এসে পড়ছে। এই দ্বিতীয়বারের ‘রেশটুকু' থাকতে থাকতেই আবার তৃতীয়বারের ছবিটা চোখে পড়ছে। তাই মনে হয়, আগাগোড়াই সমান দেখতে পাচ্ছি।

 কিন্তু ছবিটা যদি আগাগোড়া একইরকম না থেকে ক্রমাগত বদলিয়ে যেতে থাকে। মনে কর, একটা সঙ খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পর ক্রমে সে কাত হয়ে শুয়ে পড়ছে, তায় পর মাথা নিচু করে ঠ্যাং দুটোকে ঘুরিয়ে, কেমন ডিগবাজি খেয়ে, শেষটায় আবার

নানা নিবন্ধ
২৬৫