পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৭৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

টিকিট-কলে এক পেনি বা দু পেনি ফেলে দিয়েও টিকিট নেওয়া যায়। তার পর একটা লিফট বা চল্‌তিঘরে ঢুকতে হয়, সেখানে টিকিট দেখে। চল্‌তিঘর বোঝাই হলেই লোহার দরজা বন্ধ করে দেয় আর ঘরসদ্ধ সবাই একটা খাড়া পাতকুয়ার মতো সুড়ঙ্গ বেয়ে মাটির মধ্যে অন্ধকারে নামতে থাকে। পাঁচতলা বা সাততলা বাড়ির সমান নীচে নামলে পর পাতকুয়ার তলায় স্টেশনের প্লাটফরম পাওয়া যায়। সেখানে চারিদিকে বিদ্যুতের আলো। দুমিনিট পরে পরে একটা করে ট্রেন আসে আর আধ মিনিট করে থামে। এক-একটা ট্রেনে লম্বা-লম্বা পাঁচ-সাতটা গাড়ি, প্রত্যেক গাড়ির সামনে পিছনে লোহার ফটক। ফটকের পাশে লোক বসে থাকে, তারা “আর্লস্ কোর্ট’ ‘পিক্যাডিলি’ ‘হোবর্ণ’ বলে সব টেশনের নাম ডাকে আর ফটক খুলে দেয় আর লোকেরা সব হুড়্‌হুড়্ করে ওঠে আর নামে।

 ট্রেনের বন্দোবস্ত এমন আশ্চর্য কোথাও বিপদের ভয় নেই। সামনে যদি কোথাও ট্রেন আটকিয়ে থাকে, তা হলে পিছনের ট্রেন আপনা থেকেই থেমে পড়বে। ট্রেনের ড্রাইভার বা চালক যদি হঠাৎ মরেও যায়, তবুও ট্রেন স্টেশনের ধারে এসেই দাঁড়িয়ে যাবে। পাতালপুরীর ট্রেন, সেখানে বাতাস চলবার ব্যবস্থা খুব ভালো করেই করতে হয়। বড়ো বড়ো দমকলের হাওয়া দিয়ে সমস্ত টিউবটাকে সারাক্ষণ ভরিয়ে রাখতে হয়। ট্রেনগুলি সব বিদ্যুতে চলে, তাতে আগুনও জ্বলে না, ধোঁয়াও ছাড়ে না।

 অনেক সময় নদীর তলা দিয়ে সুড়ঙ্গ বসাবার দরকার হয়। নদী যদি খুব বড়ো আর খুব গভীর হয়, তা হলে তার তলা দিয়ে মাটির মধ্যে সুড়ঙ্গ নেওয়া এক ভীষণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় এ কাজটিকে সহজ করার জন্য এক চমৎকার কৌশল খাটানো হয়। আগে ডাঙার উপর সুড়ঙ্গ বানিয়ে, তার পর সেই সুড়ঙ্গ ভাসিয়ে নদীর মধ্যে ঠিক জায়গায় নিয়ে ডুবিয়ে দেয়। তাতে হাঙ্গামাও কমে, খরচও বাঁচে, কাজও হয় খুব তাড়াতাড়ি।

 বড়ো-বড়ো শহরের বড়ো-বড়ো কাণ্ড। ঘোড়া মোটর রেল ট্রাম তো সারাদিনই লোকে ভর্তি, তার উপর ডাক পার্শেল মাল মোটেরও অন্ত নাই। রাস্তার উপরেও যেমন, নীচেও তেমন-উপরেই বরং হৈচৈ, মাটির নীচে সব ঘড়ির কাঁটার মতো নিয়ম বাঁধা। এক আমেরিকার শিকাগো শহরেই সুড়ঙ্গের রেলগাড়িতে প্রতিদিন সাড়ে সাতলক্ষ মণ মাল পারাপার করে। সেখানকার বড়ো-বড়ো দোকানের আর গুদামখানার নীচের তলায় সুড়ঙ্গ থাকে, একেবারে মাটির নীচে রেলের লাইন পর্যন্ত! তারা মালপত্র সব সেখান দিয়ে শহরের তলায় তলায় চালান করে।

 কথা হচ্ছে, কলকাতায় এইরকম ভূঁইফোড় সুড়ঙ্গের রেল বসানো হবে। তা যদি হয়, তখন আর বর্ণনা করে বোঝাবার দরকার হবে না, টিকিট কিনে চড়ে দেখলেই পারবে, আর মনে করবে, এ আর একটা আশ্চর্য কি? এখন কলকাতার শহরে মোটর গাড়ি দেখলে কেউ ফিরেও তাকায় না। কিন্তু আমার বেশ মনে পড়ছে, এক সময়ে সামান্য একটা বাইসাইকেল দেখবার জন্য আমরা কিরকম উৎসাহ করে দৌড়ে আসতাম।

সন্দেশ-আশ্বিন, ১৩২৭
২৬৮
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২