পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দিবার জন্য ভারি ভারি কাঠের 'স্লিপার’ চাই—যেখানেই মার্টির নীচে খনি খোঁড়ার কাজ চলছে সেখানেই খনির দেয়ালে ছাদে ঠেকা দিবার জন্য বড়ো-বড়ো কাঠের গুঁড়ি কাঠের থাম দরকার হচ্ছে। ইউরোপের বড়ো-বড়ো শহরে রাস্তা বাঁধাবার জন্য কত অসংখ্য কাঠ ইঁটের মতো চৌকো করে কেটে বসানো হচ্ছে।

 কিন্তু কাঠকে কাজে লাগাবার জন্য আজকাল এর চাইতেও অনেক অদ্ভুত উপায় বের করা হয়েছে। কাঠ থেকে যে কাগজ তৈরি হয়, তা বোধ হয় তোমরা সকলেই জান। যত খবরের কাগজ দেখ, সে-সমস্তই কাঠের কাগজে ছাপা। কেবল কাগজ তৈরির জন্যই। প্রতি বৎসর প্রায় দশকোটি মণ কাঠের দরকার হয়। কাঠওয়ালারা কাঠকে পিটিয়ে থেঁৎলিয়ে সিদ্ধ করে একটা অদ্ভুত জিনিস বানায়, তার নাম ‘উড্‌পাল্প' (Wood-Pulp)। বাংলায় ‘কাঠের আমসত্ত’ বললে বর্ণনাটা নেহাত মন্দ হয় না। কাগজওয়ালারা নানা দেশ থেকে এই অপরূপ আমসত্ত কিনে এনে তা দিয়ে কাগজ বানায়। আগে এইরকমে কেবল সাধারণ সস্তা এবং খেলো কাগজই তৈরি হত কিন্তু আজকাল কাঠকে নানারকম প্রক্রিয়ায় ধুয়ে এমন পরিষ্কার এবং বিশুদ্ধ করা হচ্ছে যে তা থেকে খুব উচু দরের ভালো কাগজ পর্যন্ত তৈরি হতে পারে।

 কাঠের মধ্যে প্রধান জিনিসটি হচ্ছে সেলুলোস্ (Cellulose); কাঠকে বিশুদ্ধ করা মানে এই জিনিসটিকে খাঁর্টি অবস্থায় বের করা। পরিষ্কার সাদা তুলো দেখেছ ত? সেই তুলোও সেলুলোস্ ছাড়া আর কিছুই নয়। তুমি যে ধুতি পরে আছ সেও হচ্ছে সেলুলোসেরই ধুতি। কাঠ থেকে যে সেলুলোস্ বেরোয় তাতে তুলোর মতো আঁশ থাকে না কিন্তু তা থেকে খুব সস্তায় অনেক আশ্চর্য জিনিস তৈরি হচ্ছে। সেলুলোসকে রাসায়নিক উপায়ে বদলিয়ে একরকম আঠালো জিনিস তৈরি হয় তা থেকে টেনে সুতোর মতো সেলুলোসের আঁশ বার করা যায়। এই উপায়ে ইউরোপে প্রতি বৎসর কুড়ি লক্ষ মণ ‘নকল রেশম' তৈরি হয়। তার চেহারা অনেক সময়ে আসল রেশমের চাইতেও সুন্দর হয়। এই ‘রেশম’ দেশ-বিদেশে চালান দেওয়া হয়-আর কত শৌখিন লোকে সেই রেশমের পোশাক পরে বেড়ায়। তারা জানেও না যে তারা কাঠের পোশাক পরেছে।

 এই সেলুলোস্ থেকে নাকি খুব সস্তায় খাঁটি ‘স্পিরিট', অর্থাৎ আলকোহল (Alcohol) বা সুরাসার প্রভৃতি অনেক জিনিস তৈরি হতে পারবে। তখন মানুষের কলকারখানা এঞ্জিন মোটর জাহাজ সব নাকি কাঠের স্পিরিট জ্বালিয়ে চালানো হবে। অনেক হাজাররকম ওষুধপত্র আরক প্রভৃতি তৈরি করার কাজে এই সুরাসার না হলে চলে না। রাসায়নিক কারখানায় এমন দরকারি জিনিস খুব কমই আছে। সুতরাং কাঠের কুচি আর করাতের গুড়ো থেকে যদি এমন জিনিসটাকে সস্তায় পাওয়া যায় তবে তাতে যে কতদিকে মানুষের কতরকম সুবিধা হবে সে আর বলে শেষ করা যায় না। শোনা যায়, শীঘ্র নাকি বাজারে কাঠের চিনি বেরোবার সম্ভাবনা আছে। নকল চিনি নয়, সত্যিকারের চিনি।

 এতক্ষণ আমরা কাঠের গুণ ব্যাখ্যা করেছি, এখন তার জীবনচরিতের একটু পরিচয় নেওয়া যাক। পৃথিবীর নানা দেশে যত কাঠ আমদানী হয় তার মধ্যে কানাডার কাঠই সবচাইতে বেশি। সেদেশে শীতকালের গোড়াতেই গাছ কাটা আরম্ভ হয়। তার পর

নানা নিবন্ধ
২৭৩