পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/২৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সেই স্টেশন থেকে বেরিয়ে চারিদিক ছড়িয়ে পড়েছে—ঠিক যেন রাস্তার নীচে জলের পাইপ। তাদের গা থেকে আবার সরু সরু নলের মতো সূক্ষ্ম সূক্ষ শিরা বেরিয়ে সমস্ত শরীর ছেয়ে ফেলেছে-সুতোর মতো সরু, চুলের মতো সরু, তার চাইতেও আরো অনেক সরু। বুকের ধুকধুকানির তালে তালে শরীরের রক্ত শিরার ভিতর দিয়ে চলতে থাকে। চলতে চলতে যায় কোথায়? আর কোথাও যাবার জো নাই, বার বার সেই হৃৎপিণ্ডের মধ্যেই ফিরে আসতে হয়।

 আমরা যতক্ষণ বেঁচে থাকি ততক্ষণ শরীরটা ক্রমাগত ক্ষয় হতে থাকে। যত বেশি কাজ করি, যত বেশি চিন্তা করি, যত বেশি কথা বলি, যতই নড়িচড়ি, চলি, ফিরি, শরীর ততই বেশি বেশি ক্ষয় হতে থাকে। কয়লা না পোড়ালে যেমন ইঞ্জিন চলে না তেমনি শরীরকে ক্ষয় না করলে শরীরের কাজ হয় না। কিন্তু কেবলই যদি ক্ষয় হতে থাকে তা হলে শরীর টিকবে কি করে? সেজন্য শরীরকে রোজ নিয়ম মতো খাবার জোগাতে হয়। সেই খাওয়া হজম হলে শরীরের রক্ত তাকে নানা কৌশলে চারিদিকে বয়ে নিয়ে সবরকমের ক্ষয় দুর করে। শরীর যে শুধু ক্ষয় হয় তা নয়; কয়লা পুড়লে যেমন ধোঁয়া বেরোয়, ঝুল জমে আর ছাই পড়ে থাকে তেমনি শরীরের ক্ষয়ের দরুন নানারকমের দৃষিত আবর্জনা শরীরের সর্বত্র জমে উঠতে থাকে। সেই আবর্জনা দূর করাও রক্তের কাজ। হৃৎপিণ্ডের ভিতর থেকে যে পরিষ্কার টাটকা লাল রক্ত বেরিয়ে আসে সেই রক্ত যেখানে যায় সেখানকার ময়লা সাফ করতে করতে শেষটায় নিজেই ক্রমে ময়লা হয়ে পড়ে। সেই ময়লা দূষিত রক্ত আবার হৃৎপিণ্ডের মধ্যে ফিরে এসে ফুসফুসের তাজা বাতাস খেয়ে টকটকে তাজা হয়ে ওঠে।

 এক ফোঁটা রক্ত যদি অণুবীক্ষণ দিয়ে দেখ তা হলে দেখতে দেখাবে কালো কালো চ্যাপ্টা মতো। ঐ গোল গোল জিনিসগুলির আসল রঙ লাল। ঐগুলির জন্য রক্তের রঙ লাল দেখায়-তা না হলে রক্তের কোনো রঙ নাই। এই লাল দানা বা 'কণিকা'গুলি এক-একটা এত ছোটো যে এক ফোটা রক্তের মধ্যে ওরকম লাখে লাখে কণিকা ভেসে বেড়ায়। এই লাল জিনিসগুলোর ফাঁকে ফাঁকে সাদা মতন কি দেখা যাচ্ছে। সেইগুলিই হচ্ছে শরীরের প্রহরী বা বডি-গার্ড'। লাল দানাগুলি কেবল কুলি আর ধাঙড়ের কাজ করে বেড়ায়। শরীরের ময়লা সাফ করা, শরীরকে ধুয়ে মুছে বাতাস খাইয়ে তাজা রাখা, এ-সবই হচ্ছে ঐ লাল কণিকাদের কাজ। কিন্তু শত্রুর সঙ্গে যখন লড়াই করতে হয় তখন ডাক পড়ে ঐ সাদা প্রহরীদের।

 যেমনি শরীরে রোগের বীজ ঢোকে অমনি চারিদিকে সাড়া পড়ে যায়। আর প্রহরীরা দলে দলে রক্তের স্রোতে ভেসে এসে রোগের সঙ্গে লড়াই বাধিয়ে দেয়। টপাটপ্ রোগের বীজ খেয়ে ফেলতে থাকে। লড়াই যখন সঙ্গীন হয় তখন দলে দলে প্রহরী মরতে থাকে, আর নূতন প্রহরীর দল দ্বিগুণ উৎসাহে সড়তে আসে। এরকম ছোট ছোট লড়াই শরীরের মধ্যে চব্বিশ ঘটাই চলছে। মানুষের রোগ যখন সাংঘাতিক হয়, যখন প্রহরীরা কিছুতেই আর রোগের বীজগুলোর সঙ্গে লড়াই করে পেরে ওঠে না তখন মানুষের প্রাণ নিয়ে টানাটানি হয়। যখন রোগের বীজ ক্রমশই শরীরটাকে দখল করতে থাকে তখন শরীরময় হৈচৈ পড়ে

২৮৪
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২