পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৩১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

না করিলে এখনো তাহারা লাখে লাখে মাঠে মাঠে ঘুরিয়া বেড়াইত। মানুষ কয় বৎসর সেখানে বসবাস না করিতেই পঞ্চাশ লক্ষ বাইসন খাইয়া হজম করিয়াছে। এক-এক দল লোক এক-এক বারে দশ-বিশ হাজার বাইসন মারিয়া তবে ছাড়ে।

 হাতির দল বাঁধিয়া বনে বনে ঘুরিয়া বেড়ায় এরূপ অনেক সময়েই দেখা যায় কিন্তু সেটা কেবল খাবার সংগ্রহের চেষ্টা মাত্র! দেশ ছাড়িয়া লম্বা দৌড় দেওয়ার অভ্যাসটা তাহার নাই। অর্থাৎ আজকাল নাই। হাতির যাহারা পূর্বপুরুষ, তাহারা যে দেশ-বিদেশ বিচরণ করিতে কিছুমাত্র ত্রুটি করে নাই, তাহার ঢের প্রমাণ পাওয়া যায়। ইংলণ্ড বলো, আমেরিকা বলো, গ্রীষ্মপ্রধান আফ্রিকা বলে। আর শীতপ্রধান সাইবেরিয়া বলো, সকল স্থানেই জীবন্ত হাতি না পাও, হস্তীজাতীয় জন্তুর কংকালচিহ্ন পাইবে। আফ্রিকার উত্তর দিকে ইজিপ্টের মধ্যে বহু পুরাতন একটা শূকরের মতো জানোয়ারের কংকাল পাওয়া গিয়াছে, পণ্ডিতেরা বলেন যে সেই নাকি হাতির একজন পূর্বপুরুষ। বিদেশ ভ্রমণ কাহাকে বলে তাহা এই জানোয়ারের বংশধরেরা খুব ভালো করিয়া দেখাইয়া গিয়াছে। হাতির কথা বলিতে গেলে আপনা হইতেই ঘোড়ার কথা মনে আসে। হাতির মতো ঘোড়াও, অর্থাৎ তাহার পূর্বপুরুষও এক সময়ে পৃথিবীময় ঘুরিয়া বেড়াইয়াছে। কিন্তু সে ঘোড়া আর অজিকালকার মানুষের পোষা ঘোড়ায় আকাশ-পাতাল তফাত—ঠিক যেমন নেকড়ে বাঘ আর শৌখিন কুকুরের প্রভেদ।

 হরিণের দল বাঁধিয়া চলার কথা বোধ হয় সকলেই জান। বড়ো-বড়ো শিংওয়ালা হরিণগুলি যখন প্রকাণ্ড দল বাঁধিয়া নদী পার হইতে থাকে, সে নাকি এক চমৎকার দৃশ্য। নদীর এপার হইতে ওপার পর্যন্ত কেবল হরিণের মাখা আর হরিণের শিং। মনে হয় যেন জীবন্ত সাঁকো ফেলিয়া নদীর জলে বাঁধ দেওয়া হইয়াছে। পাঁচ-দশ হাজার হরিণ এইরূপে একসঙ্গে বাহির হয়। প্রায়ই দেখা যায় তাহারা এমন নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পথে যাতায়াত করে যে, শিকারীরা আগে হইতে আন্দাজ করিয়া সময়মতো ঠিক জায়গায় খাপ পাতিয়া বসিয়া থাকে।

 কিন্তু জানোয়ারের বিদেশযাত্রার কথা বলিতে গিয়া যদি কেবল বড়ো-বড়ো জানোয়ারের কথাই বলি, তবে আসল কথাটাই বাদ থাকিয়া যাইবে। এ সম্বন্ধে যত আশ্চর্য কথা শুনিয়াছি, তাহার মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে সেমিঙের কথা।

 পাহাড়ের ধারে যেখানে সবুজ গাছ আর কচি পাতার অভাব নাই, সেইখানে গর্ত করিয়া লেমিং বাস করে। দেখিতে তাহারা ইঁদুরের চাইতে বড় নয়, চেহারাও সেইরকম—কেবল লেজ নাই বলিলেই হয়। আর বিশেষ আশ্চর্য তাহাদের বংশবৃদ্ধি। যেখানে অজি দেখিবে কুচিৎ দু-দশটা লেমিং দেখা যায়, বৎসরেক বাদে গিয়া দেখিবে লেমিঙের বংশে পাহাড় ছাইয়া ফেলিয়াছে। সংখ্যায় যত বাড়ে, তত তাহারা গাছপালা খাইয়া শেষ করে। শেষে এমন অবস্থা হয় যে, আর সবজি জোটে না। পাহাড়কে পাহাড় একেবারে নেড়া হইয়া যায়। তখন ঘোর দুর্ভিক্ষের মধ্যে ক্ষুধার যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া তাহারা ব্যস্ত হইয়া বেড়ায়। মনে হয়, যেন তাহাদের মধ্যে খুব একটা আন্দোলন চলিয়াছে, যেন তাহারা কোনোরূপে পরামর্শ স্থির করিতে পারিতেছে না। তার পর একদিন কি ভাবিয়া তাহারা একেবারে দলেবলে পাগলের মতো দেশ ছাড়িয়া পলাইতে আরম্ভ করে।

৩১৪
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২