পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৩২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

গড়িবার নানারকম কায়দা দেখা দিল—ঠ্যাঙাইবার অস্ত্র, গুতাইবার অস্ত্র, ছুঁড়িয়া বিধাইবায় অস্ত্র, কোপাইয়া কাটিবার অস্ত্র, ভারী ভারী ভোঁতা অস্ত্র, পাথরে-খোদাই ধারালো অস্ত্র। যেদিন মানষ আগুনকে কাজে লাগাইতে শিখিল, আর যেদিন সে নানারকম ধাতর ব্যবহার শিখিল সেইদিন মানুষের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় দিন। সেইদিন হইতে মানুষ যথার্থরূপে বুঝিতে পারিয়াছে যে, জগতে তাহার প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেহ নাই।

সন্দেশ—জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৪
বিদ্যুৎ মৎস্য

 এক-একরকম জানোয়ারের এক-একরকম অস্ত্র। কেউ শিং দিয়ে গুঁতায়, কেউ নখ দিয়ে আঁচড়ায়, কেউ দেয় দাঁতের কামড়, কেউ মারে হুলের খোঁচা। ক্যাঙারুর ল্যাজের ঝাপটা, ঈগলের ধারালো ঠোঁট, অস্ত্র হিসাবে এগুলিও বড়ো কম নয়। কিন্তু তার চাইতেও অশ্চির্য অস্ত্র আছে একরকম বান মাছের গায়ে। তোমরা কেউ ‘ব্যাটারির’ ‘শক খেয়েছ কি? কিম্বা খোলা বিদ্যুতের তারে ভুলে হাত দিয়েছ কি? এই মাছকে ধরতে গেলে গায়ের মধ্যে ঠিক তেমনি ধাক্কা লাগে।

 এই অদ্ভুত মাছকে ইংরাজিতে বলে Electric Eel অর্থাৎ বৈদ্যুতিক ঈল। বান মাছের মতো চেহারা, সাপের মতো লম্বা, মুখে ধারাল দাঁত—এক-একটি ঈগল পাঁচ-ছয় হাত পর্যন্ত বড়ো হয়। এই জাতীয় মাছ পৃথিবীর নানা স্থানে পাওয়া যায়, কিন্তু যেগুলিতে বিদ্যুতের তেজ দেখা যায় সেগুলি থাকে কেবল আমেরিকার বড়ো-বড়ো নদীর ধারে-কাছে। এক-একটা ঈগলের এমন অশ্চির্য তেজ, তারা বিদ্যুৎ চালিয়ে অন্য মাছদের তো মেরে ফেলেই, এমনকি, বড়ো-বড়ো জানোয়ারগুলোকেও এক-এক সময় তারা অস্থির করে তোলে। গোরু, ঘোড়া পর্যন্ত কত সময়ে জল খেতে নেমে ঈগলের পাল্লায় পড়ে যন্ত্রণায় লাফালাফি করতে থাকে। সেদেশের লোকেরা রীতিমতো বর্শা বল্লম নিয়ে এই মাছ শিকার করে, কারণ, কোনোরকমে তার গায়েগা ঠেকলেই বড়ো-বড়ো জোয়ান মানুষকেও বাপ রে মা রে করে চেঁচাতে হয়। একবার কতগুলো ঘোড়া একটা বিলের মধ্যে জল খেতে গিয়েছিল। সেখানে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশটা বড়োবড়ো ঈল এক জায়গায় জড়ো হয়েছিল। ঘোড়াগুলো তার মাঝখানে পড়েই চীৎকার করে লাথি ছুড়ে ডাঙায় পালিয়ে আসল। কিন্তু একটা ঘোড়া তার মধ্যে একটু বেশি কাহিল হয়েছিল, সেটা অনেকক্ষণ পর্যন্ত জলের ধারে অধিমরা অবস্থায় পড়েছিল। ঈগলগুলোও অবশ্য লাথির চোটে সেখানে বেশিক্ষণ টিকতে পারে নি।

 এমন ই সাংঘাতিক অস্ত্র এরা কেমন করে ব্যবহার করে, আর কেমন করে তাদের শরীরের মধ্যে এতখানি বিদ্যুৎ সঞ্চিত হয়, তা এখনো পণ্ডিতেরা খুব স্পষ্ট করে বলতে পারেন নি। মাছটাকে ধরে চিরলে পরে দেখা যায়, তার শিরদাঁড়ার দুই পাশে পিঠ থেকে ল্যাজ পর্যন্ত ছোটোছোটো কোম্ন, তার মধ্যে একরকম আঠালো রস। এইটিই তার বৈদ্যুতিক অস্ত্র। অস্ত্রের ব্যবহার করতে হলে সে কেবল তার শরীরটাকে বাঁকিয়ে ল্যাজ আর মাথা শক্রর গায়ে ঠেকিয়ে দেয়।

জীবজন্তুর কথা
৩১৯