পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৩৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ঠোঁট। উপরেরটা শিং বলতে পার—সেটার সঙ্গে তার মুখ বা ঠোঁটের কোনো সম্পর্কই নেই। অত বড়ো একটা জমকাল শিং দিয়ে তার কি যে কাজ হয়, তা তো দেখতে থাই না। অত্যন্ত নিরীহ পাখি, কারও সঙ্গে ও গুঁতাগুঁতি করবার সাহস তার আছে কিনা সন্দেহ। চেহারা দেখলে মনে হয়—’বাপ্ রে। এই ঠোঁটের একটি ঠোকর খেলেই তো গেছি’। কিন্তু নিতান্ত ঠেকা না পড়লে ও তা মারার অভ্যাসটিও তার নেই বললেই হয়।

 এত বড়ো ঠোট তার উপর এমনধারা শিং, এই বিষম বোঝা বয়ে বয়ে পাখিটার মাথাও কি ধরে না? চলতে ফিরতে উড়তে গিয়ে সে কি উলটেও পড়ে না? আসল কথা কি জান? তার ঠোঁটটি আর শিংটি আগাগোড়াই ফাপা, কাকড়ার খোলার মতো হালকা। তাই তার ঠোট নিয়ে বড়ো-বড়ো গাছের আগডালের উপরে সে লাফিয়ে বেড়ায়- খাবার দেখলে ঝুপ করে উড়ে এসে পড়ে। কেবল তাই নয়, তার দিকে খাবারের টুকরো ছুড়ে দেখ দেখি সে কেমন চট্‌পট, ঘাড় ফিরিয়ে তার বিশাল ঠোঁটের মধ্যে খাবার লুফে নেবে। এ বিষয়ে তার মতো ওস্তাদ আর বোধ হয় দ্বিতীয় নেই; আর এমন খানেওয়ালাও বোধ হয় আর একটি পাওয়া দুষ্কর।

 এক সাহেবের এক পোষা ধনঞ্জয় ছিল—সে আমাদের দেশে নয়, বোনিও দ্বীপে। সেদেশে এই পাখি অনেকেই পুষে থাকে। সাহেব বলেন, এমন সর্বনেশে পেটুক জীব আর কোথাও মেলে না। সেই এতটুকু বাচ্চা বয়স থেকেই তাকে খাইয়ে খাইয়েও মানুষে ঠাণ্ডা রাখতে পারত না। এইমাত্র খাইয়ে গেলে, আবার পাচ মিনিট পরেই দেখবে হতভাগা ল্যাজের উপর ভর দিয়ে পা মুড়ে বসে বসে প্রকাণ্ড হা করে ক্যাচ ক্যাচ শব্দে বিকট কান্না লাগিয়েছে। তার পর একটু বয়স হলে তখন তার অত্যাচারে বাড়িতে টেকা দায় হয়ে উঠল। খাবার সময় তার ঠ্যাঙে দড়ি বেঁধে তাকে আটকে রাখতে হত, তা নইলে সে পাতের খাবায়ে, ভাতের হাড়িতে, ব্যঞ্জনের বাটিতে, দুধের কড়ায়, যেখানে সেখানে মুখ দিয়ে সকলকে অস্থির করে তুলত। মাছমাংস, ডালভাত, রুটিবিস্কুট, ময়দার ডেলা, যা দাও তাতেই সে খুশি, কিন্তু পেট ভরে দেওয়া চাই। পেটটি ভরলেই সে উড়ে গিয়ে গাছের আগায় বিশ্রাম করবে, রোদ পোহাবে তার প্রাণপণে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নতুন করে সাংঘাতিক খিদে ডেকে আনবে।

 ধনঞ্জয় পাখির চালচলন স্বভাব যারা লক্ষ্য করেছেন, তারা বলেন, এই পাখির বাসা বাঁধবার ধরনটি তার চেহারার চাইতে কম অদ্ভুত নয়। যখন ছানা হবার সময় হয় তখন মা-পাখিটা একটা গাছের কোটরের মধ্যে আশ্রয় নেয়, আর বাবা পাখি সেই কোটরের মুখটাকে কাদামাটি শ্যাওলা দিয়ে বেশ করে এটে বন্ধ করে দেয়—কেবল একটুখানি ফোকর রাখে, তা না হলে বাইরে থেকে খাবার দেবে কি করে? সেই কোটরের মধ্যে ডিম পেড়ে মা-পাখি দিনের পর দিন তার উপর বসে বসে তা দেয়। আর বাবা-পাখি বাইরে থেকে পাহারা দেয়, আর ফোকরের ভিতর দিয়ে সারাদিন খাবার চালান করে। এমনি করে যখন ডিম ফুটে ছানা বেরোয়, আর সেই ছানাগুলো যখন একটু বড়ো হয়, তখন বাসা ভেঙে মাপাখি বেরিয়ে আসে। এতদিন বদ্ধ জায়গায় বসে বসে তার পা এমন আড়স্ট হয়ে যায় যে কোটর থেকে বেরোবার পর অনেকক্ষণ পর্যন্ত সে উড়তে পারে না, ভালো করে চলতে ফিরতেও

৩৩২
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী ২