পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৩৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

বলিয়া তাহাকে অনেকদিন পর্যন্ত কাজে লাগাইবার সুবিধা হয় নাই—এখন তিমির ছাল কলে পিষিয়া চবি বাহির করিয়া চমৎকার মজবুত চামড়া তৈয়ারি হইতেছে। সুতরাং মানুষের মতো এ-হেন অত্যাচারী রাক্ষসের হাত এড়াইবার জন্য তিমি গভীর সমুদ্রে পলাইয়া হয়তো এখনো বাঁচিতে পারেনা হইলে তাহার বংশ লোপ হওয়ার খুবই আশংকা আছে।

 এত বড়ো প্রাণীটা, কিন্তু মোটের উপর তাহার স্বভাবটি বেশ নিরীহ বলিতে হইবে। অনেক সময়ে দেখা যায় তিমির দল সমুদ্রের উপর ভাসিয়া আসিয়া খেলা করিতেছে। তাহাদের একটাকে মারিলে বাকিগুলা ব্যস্ত হইয়া চারিদিকে ভিড় করিয়া আসে। তখন একটার পর একটাকে বল্পমে গাঁথিয়া দলকে-দল মারিয়া ফেলা খুবই সহজ হইয়া পড়ে। কিন্তু সব তিমি সম্বন্ধে এ নিয়ম খাটে না। কোনো কোনো দাঁতওয়ালা তিমি আছে, তাহাদের মেজাজটা দস্তুরমতো বদরাগী। এ বিষয়ে মোম তিমির দুর্নাম সবচাইতে বেশি। মাঝে মাঝে এক-একটা দলছাড়া মোম তিমি দেখা যায়, তাহাদের ঘাটাইবার দরকার হয় না। জাহাজ দেখিলেই তাহারা তাড়া করিয়া যায়। তিমির তাড়া যে কেমন তাড়া, সে তাড়া যে খাইয়াছে সেই জানে। কখনো সে টু মারে, কখনো সে হাঁ করিয়া কামড়াইতে আসে, কখনো তাহার গায়ের ধাক্কায় জাহাজ চুরমার হয়—অথবা লেজের ঝাপটায় প্রলয় কাণ্ড উপস্থিত করে, এই ভয়ে মাঝি-মাল্লা ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়ে। আর যাহাদের ‘নিরীহ তিমি’ বলি, তাহারাও যখন মরিবার সময় সমুদ্র তোলপাড় করিয়া ছটফট করে তখন সেও প্রকটা কম সাংঘাতিক ব্যাপার হয় না।

 তিমির খাওয়ার মধ্যেও রকমারি দেখা যায়। যাহাদের দাঁত নাই, তাহারা সমুদ্রের মধ্যে ছোটো-ছোটো মাছের ঝাঁক খাইয়া বেড়ায়। এক-এক বার হাঁ করিয়া মাছের ঝাঁকসুদ্ধ সমুদ্রের জল মুখের ভিতর পুরিয়া লয়। তার পর সেই কাঁচকড়ার ঝালরের ভিতর দিয়া সেই জল ফুকিয়া বাহির করে-মাছগুলা সব এই অদ্ভুত ছাঁকনিতে আটকাইয়া থাকে। ইহাদের গলার ফুটা এত ছোটো যে নিতান্ত পুঁটি বাটা ছাড়া কোনো বড়ো মাছ গেলা ইহাদের সাধ্য নয়। কিন্তু দাঁতালো তিমিরা এরকম খুচরা খাইয়া সন্তুষ্ট হয় না। তাহারা বড়ো-বড়ো সমুদ্রের জন্তুকে মারিয়া খায়। মোম তিমিরা এক মাইল গভীর সমুদ্রে ডুব মারিয়া সেখানকার বড়ো-বড়ো বিদঘুটে জন্তুগুলাকে খাইতে ছাড়ে না। একবার একটা তিমির পেটে একটা প্রকাণ্ড অক্টোপাসের কিছু কিছু টুকরা পাওয়া গিয়াছিল। তাহার এক-একটি পা হাতির পায়ের সমান মোটা! সে জন্তুটা যে আট-দশটা হাতির সমান বড়ো ছিল, তাহাতে আর কোনো সন্দেহ নাই।

 ‘তিমি মাছ’ যে আসলে মাছই নয়, সে কথা তোমরা নিশ্চয়ই জান। ইহারা স্তন্যপায়ী জন্তু। ইহাদের এক-একটি ছানা হয় ঘোড়ার মতো মস্ত; তাহারা জন্মিয়া মায়ের দুধ খায়। মাছ যেমন অনায়াসে জলের নীচে ডুবিয়া থাকে—তিমি সেরকম পারে না। নিশ্বাস লইবার জন্য তাহাকে বার বার জলের উপরে উঠিতে হয়। কখনো কখনো জোরে নিশ্বাস ছাড়িবার সময় তাহার নাক হইতে গরম বাতাসের ঝাপটা ছুটিয়া সমুদ্রের উপর জলের ফোয়ারা উঠিতে থাকে। তাহা দেখিয়া শিকারীরা বুঝিতে পারে—ঐখানে তিমি।

সন্দেশ—কার্তিক, ১৩২৫
জীবজন্তুর কথা
৩৪৭