তার পর দু বছর কেটে গেছে—সেই খুকির বাবা-মার কোনো খবর পাওয়া যায় নি। সেই সৈন্যদলই এখনো তাকে খরচ দিয়ে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করছে। অবশ্য এখন সে আর লড়াইয়ের জায়গায় থাকে না—সে থাকে লণ্ডনে—সকলে তার নাম রেখেহে ফিলিস্।
সে প্রায় ছয়শত বৎসর আগেকার কথা-সে সময়ে ইংরজি ও ফরাসিতে প্রায়ই যুদ্ধ চলিত। দুই পক্ষেই বড়ো-বড়ো বীর ছিলেন - তাঁহাদের আশ্চর্য বীরত্বের কাহিনী ইউরোপের দেশ-বিদেশে লোকে অবাক হইয়া শুনিত।
ইংলণ্ডের রাজা তৃতীয় এড্ওয়ার্ড তখন খুব বড়ো সৈন্যদল লইয়া ফ্রন্সে যুদ্ধ করিতেছিলেন। ফ্রান্সের উত্তর দিকে সমুদ্রের উপকুলে ইংলণ্ডের খুব কাছাকাছি একটি শহর আছে, তাহার নাম ‘ক্যালে’ (Calais)। এই শহরটির উপর বহুকাল ধরিয়া ইংরাজদের চোখ ছিল-কারণ, এইটি দখল করিতে পারিলে, ফ্রান্সে যাওয়া-আসার খুবই সুবিধা হয়। এডওয়ার্ড জলস্থল দুইদিক হইতে এই শহরটিকে ঘেরাও করিয়া ফেলিলেন। ক্যালে শহরে সৈন্য-সামন্ত বেশি ছিল না, কিন্তু সেখানকার দুর্গ বড়ো ভয়ানক। তার চারিদিক উঁচু দেয়াল ঘেরা-সেই দেয়ালের বাহিরে প্রকাণ্ড খাল—এক-একটা ফটকের সামনে এক-একটি পোল-সেই পোল দুর্গের ভিতর হইতে গুটাইয়া ফেলা যায়। সে সময়ে কামান ছিল বটে-তাহার গোলাতে মানুষ মরে কিন্তু দুর্গ ভাঙে না। সুতরাং জোর করিয়া দুর্গ দখল করা বড়ো সহজ ছিল না। কিন্তু এওয়ার্ড তাহার জন্য ব্যস্ত হইলেন না—তিনি শহরের পথঘাট আটকাইয়া, প্রকাণ্ড তাম্বু গাড়িয়া দিনের পর দিন নিশ্চিন্তে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। মতলবটি এই যে, যখন দুর্গের ভিতরের খাবার সব ফুরাইয়া আসিবে আর ভিতরের লোকজন ক্রমে কাহিল হইয়া পড়িবে, তখন তাহারা আপনা হইতেই হার মানিবে। মিছামিছি লড়াই হাঙ্গামা করিবার দরকার হইবে না।
‘ক্যালে'র লোকেরা যখন দেখিল, ইংরাজেরা চারিদিক হইতে পথঘাট ঘিরিয়া ফেলিতেছে, তখন তাহারা শিশু, বৃদ্ধ, অক্ষম এবং দুর্বল লোকদিগকে এবং স্ত্রীলোকদিগকে শহরের বাহিরে পাঠাইয়া দিল।
তার পর কিছুদিন ধরিয়া ইংরাজ ও ফরাসিতে রেষারেষি চলিতে লাগিল। ফরাসিদের মতলব, বাহির হইতে দুর্গের ভিতরে খাবার পৌঁছাইবে -ইংরাজের চেষ্টা যে সেই খাবার কিছুতেই ভিতরে যাইতে দিবে না। ডাঙার পথে খাবার পৌঁছানো একরূপ অসম্ভব ছিল - কারণ, সেদিকে ইংরাজদের খুব কড়াক্কড় পাহারা। সমুদ্রের দিকেও ইংরাজদের যুদ্ধ-জাহাজ সর্বদা ঘোরাঘুরি করিত কিন্তু অন্ধকার রাত্রে তাহাদের এড়াইয়া, ফরাসি নাবিকের মাঝে মাঝে রুটি, মাংস, শাকসজি প্রভৃতি শহরের মধ্যে পৌঁছাইয়া দিত। মোরঁৎ ও মেস্ত্রিয়েল নামে দুইজন নাবিক এই কাজে আশ্চর্য সাহস ও বাহাদুরি দেখাইয়াছিল। একবার নয়,