পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৬২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

একেবারে মাটি হইয়া গেল। ইহারা কেবল কথা কাটাকাটি করিতে শিখিল—কেহ জানলাভ করিতে চায় না, মানুষের মতো মানুষ হইতে চায় না—শুধু লোকের কাছে নাম কিনিতে চায়, ছলেবলে ক্ষমতা জাহির করিতে চায়। সক্রেটিস তেজের সহিত্ত চারিদিকে বলিতে লাগিলেন, “এমন করিয়া কোনো মানুষ বড়ো হইতে পারে না। কেবল টাকাকড়ি ও যশ-মানের জন্য ছুটাছুটি করিও না, ধর্মপথে থাক এবং জ্ঞানলাভ কর— নহিলে তোমরা অধঃপাতে যাইবে।” লোকে অবাক হইয়া গরিবের মুখে এই-সকল কথা শুনিত এবং যে একবার আসিত সেই তাঁহার কথায় ও আশ্চর্য ব্যবহারে মুগ্ধ হইয়া ষাইত। দেখিতে দেখিতে সক্রেটিসের অনেক বন্ধু ও শিষ্য জুটিয়া গেল। শহরের অনেক বড়ো-বড়ো লোক পর্যন্ত তাহার কাছে যাতায়াত আরম্ভ করিল। কোনো বিদেশী রাজা অনেক টাকার লোভ দেখাইয়া সক্রেটিসকে তাহার নিজের সভায় লইতে চাহিলেন। কিন্তু সক্রেটিস বলিলেন, “আমি এ অনগ্রহ লইয়া আপনার কাছে ঋণী থাকিতে চাহি না। আমার টাকারই-বা প্রয়োজন কি? এই এথেন্স শহরে অতি অল্প খরচেই দুবেলা আহার করিয়া থাকা যায়; আর কাছেই ঝরনার জল, তাহার জন্য পয়সা দিতে হয় না। সুতরাং আমার তো কোনো অভাব দেখি না।”

 সে সময়ে গ্রীস দেশে প্রায়ই যুদ্ধবিগ্রহ চলিত। একবার কোনো-এক যুদ্ধে সক্রেটিসকে পাঠানো হইল। যাহারা যুদ্ধ করিতে গিয়াছিল তাহাদের মধ্যে অনেকেই দেশে ফিরিয়া, সক্রেটিসের আশ্চর্য শক্তির প্রশংসা করিতে লাগিল। ঘোর শীতের সময়ে যখন বরফে সকল দিক ঢাকিয়া ফেলে, লোকেরা কম্বলের জামা গায়ে দিয়াও শীতে কাঁপিতে থাকে, সক্রেটিস তাহার মধ্যে খালি পায়ে সামান্য কাপড় পরিয়া অনায়াসে ঘুরিয়া বেড়াইতেন। ডেলিয়ামের যুদ্ধে যখন শত্রুপক্ষ সক্রেটিসের দলকে হটাইয়া দিল, তখনকার একজন প্রসিদ্ধ যোদ্ধা বলিয়াছেন, সেই বিপদের সময়েও সক্রেটিসের শান্ত চেহারা ও নিশ্চিন্ত হাসিমখ দেখিয়া এথেন্সের লোকদের মনে আবার সাহস ফিরিয়া আসিল। শত্রতপক্ষের সৈন্যরা চারিদিকে মারধর করিতেছিল কিন্তু সক্রেটিসের কি আশ্চর্য তেজ, তাহার কাছে ঘেষিতেও কেহ সাহস পায় নাই।

 সক্রেটিস নিজে গরিবের গরিব কিন্তু সারাজীবন সকলকে বিনা পয়সায় শিক্ষা দিতেন। এত বড়ো পণ্ডিত, কিন্তু তাহার মধ্যে অহংকারের লেশমাত্র ছিল না। কেহ তাঁহাকে রাগ করিয়া কথা বলিতে শুনে নাই, নিজের সামান্য কর্তব্যটুকুও অবহেলা করিতে দেখে নাই। শত্রুমিত্র সকলের জন্য মুখে তাহার হাসিটুকু লাগিয়াই থাকিত। কেহ কড়া কথা বলিলে বা মিথ্যা গালাগালি করিলেও তিনি তাহাঁতে বিরক্ত হইতেন না। কত দুগুট লোকে তাহার উপদেশ শুনিতে গিয়া কাদিয়া ফিরিত, তাহার যুখের একটি কথায় কত অন্যায়, কত অত্যাচার থামিয়া যাইত। দুঃখ বিপদের সময় কতদূর হইতে কত লোকে তাহার পরামর্শ শুনিবার জন্য ছুটিয়া আসিত। যাহা ন্যায় বুঝিব তাহাই করিব’ এ কথা তাঁহার মুখেই শোভা পাইত • কারণ তাহার যেমন কথা তেমনি কাজ। এমন সাধু জোককে যে সকলে ভালোবাসিবে, ঋষি বলিয়া ভক্তি করিবে তাহাতে আশ্চর্য কি? কিন্তু সক্রেটিসেরও শত্রুর অভাব ছিল না। একদল লোক—কেহ হিংসায় কেহ রাগে কেহ

জীবনী
৫৯