পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৬৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কিরূপে এ অবস্থা দূর হয় এই ভাবনায় সকলে অস্থির হইয়া পড়িল। তখন ইংলণ্ডের যুদ্ধমন্ত্রী নিজে ফুরেন্স নাইটিঙ্গেলকে লিখিলেন, “আপনি এই কাজের ভার লইতে পারেন কি?” এমন ডাক শুনিয়াও কি ফুরেন্স নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন? তিনি কিছুমাত্র সময় নষ্ট না করিয়া, চৌত্রিশ জন শুশ্রষাকারিণী (nurse) সঙ্গে যুদ্ধস্থানে চলিলেন। গুনিয়া দেশসুদ্ধ লোকে আশ্বস্ত হইয়া বলিল, “আর ভয় নাই।”

 ‘মিস নাইটিঙ্গেলের দল’ যুদ্ধক্ষেত্রে পৌছিয়া দেখিলেন কাজ বড়ো সহজ নয়। ছোট্টো একটি হাসপাতাল, তাহার মধ্যে চারহাজার লোক ঘেঁষাঘেঁষি করিয়া শুইয়া আছে। অধিকাংশই জ্বর ও আমাশয়ে ভুগিতেছে—আহতের সংখ্যা খুবই কম। ঔষধের কোনো ব্যবস্থা নাই-পথ্যাপথ্যের বিচার নাই-যাহার ভাগ্যে যাহা জুটিতেছে সে তাহাই খাইতেছে। তার উপর হাসপাতালের বিছানাপত্র সমস্ত এমন ময়লা ও দুর্গন্ধ যে, সুস্থ লোকেও সেখানে অসুস্থ হইয়া পড়ে। শুশ্রষাকারিণীর দল প্রথমে নিজেরা হাসপাতাল ধুইয়া সাফ করিলেন। তার পর প্রত্যেকটি বিছানা মাদুর চাদর পরিষ্কার করিয়া কাচিলেন। কে কি খাইবে, কাহার কি ঔষধ চাই, এ-সমস্তের ব্যবস্থা করিলেন। মিস নাইটিঙ্গেল নিজে রান্নাঘরের সমস্ত গুছাইয়া পথ্যের বন্দোবস্ত করিলেন। দেখিতে দেখিতে হাসপাতালের চেহারা ফিরিয়া গেল। চারিদিক ঝরঝরে পরিষ্কার। ক্রমে হতাশ রোগীদের মুখে প্রফুল্লতা দেখা দিল—চারিদিকে সকলের উৎসাহ জাগিয়া উঠিল—সকলে বলিল, “মিস নাইটিঙ্গেল নিজে সব ভার লইয়াছেন, আর ভয় নাই।” যেখানে অর্ধেকের বেশি লোক বিনা চিকিৎসায় মরিতেছিল, সেখানে এখন শতকরা আটানব্বই জন প্রাণে বাঁচিয়া মিস নাইটিঙ্গেলের জয়জয়কার করিতে লাগিল। তাঁহার আর বিশ্রাম নাই, সকলের খবর লইতেছেন, সকলের কাছে কত কথা বলিতেছেন-কতজনকে প্রফুল্ল রাখিবার জন্য কত গল্প করিতেছেন-কতজন লিখিতে পারে না, তিনি তাহাদের চিঠি লিখিয়া দিতেছেন। সাধে কি তাহারা বলিত, “ফুরেন্স নাইটিঙ্গেল স্বর্গের দেবী, তাহার ছায়া লাগিলে মানুষ পবিত্র হয়।”

 তার পর যখন যুদ্ধ শেষ হইল, সকলে দেশে ফিরিল—তখন ফুরেন্স নাইটিঙ্গেলের সম্মানের জন্য বিপুল আয়োজন চলিতে লাগিল। তিনি সে-সমস্ত এড়াইয়া ভগ্ন শরীরে চুপচাপ লুকাইয়া দেশে ফিরিলেন। কিন্তু লোকে তাহা শুনিবে কেন? তাহারা তাহার জন্য মনুমেণ্ট তুলিয়া, লক্ষ লক্ষ টাকা চাঁদা উঠাইয়া, তাঁহার নামে শুশ্রুষ-শিক্ষার আয়োজন করিয়া, তাহার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখাইয়াছে। রাজা প্রজা সকলে মিলিয়া তাহার কাছে মাথা নত করিয়াছে; দেশ-বিদেশ হইতে কতরকমের সম্মনি তাহার উপর ঢালিয়া দেওয়া হইয়াছে। স্বয়ং মহারানী ভিক্টোরিয়া বার বার তাহার প্রশংসা করিয়া বলিয়াছিলেন, “তুমি যে কাজ করিলে তাহার আর তুলনা হয় না।” ইহার পরেও মিস নাইটিঙ্গেল প্রায় পঞ্চাশ বৎসর বাঁচিয়া ছিলেন এবং জীবনের শেষপর্যন্ত সর্বদাই অসংখ্য প্রকার সেবার কাজে আপনাকে নিযুক্ত রাখিয়াছিলেন। এখন এই যে ইউরোপের যুদ্ধে এত ‘রেডক্রস’ ‘এম্বুলেন্স' প্রভৃতির নাম শোন, আহতের সেবার জন্য এত চেষ্টা, এত আয়োজন দেখ, বলিতে গেলে এ-সমন্তেরই মূলে ফুরেন্স নাইটিঙ্গেল।

সন্দেশ-ভাদ্র, ১৩২৩
জীবনী
৬৩