পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
অজানা দেশে

 সেদিন একটা বইয়ে মাগো পার্কের কথা পড়ছিলাম। প্রায় সওয়া শশী বৎসর আগে অর্থাৎ লিভিংস্টোনের অনেক পূর্বে মাঙ্গো পৰ্কি আফ্রিকার অজানা দেশ দেখতে গিয়েছিলেন। এক-একজন মানুষের মনে কেমন নেশা থাকে, নূতন দেশ নূতন জায়গার কথা শুনলে তারা সেখানে ছুটে যেতে চায়। তারা অসুবিধার কথা ভাবে না, বিপদ-আপদের হিসাব করে না—একবার সুযোগ পেলেই হয়। মাঙ্গো পার্ক এইরকমের লোকে ছিলেন। তাঁর বয়স যখন চব্বিশ বৎসর মা, তখন তিনি নাইগার নদীর সন্ধান করতে গিয়েছিলেন। তার কিছুদিন আগে একজন ইংরজি সেই অজানা দেশে ডাকাতের হাতে মারা যান—অথচ পার্ক তা জেনেও মাত্র দুজন সে-দেশী চাকর সঙ্গে সেই পথেই বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর উদ্দেশ্য সেই নদী ধরে ধরে তিনি আফ্রিকার ঐ অঞ্চলটা বেশ করে ঘুরে আসবেন। তখনো আফ্রিকার ম্যাপে সেই-সব জায়গায় বড়ো-বড়ো ফাক দেখা যেত আর সেগুলোকে ‘অজানা দেশ’ বলে লেখা হত।

 সে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সে সময়ে অনেকটা আরব ও মুর জাতীয় মুসলমানদের হাতে ছিল। ইউরোপীয় লোক সেখানে গিয়ে পাছে তাদের ব্যবসা কেড়ে নেয়, এই ভয়ে সাহেব দেখলেই তারা নানারকম উৎপাত লাগিয়ে দিত। পার্ককেও তারা কম জ্বালাতন করে নি; কতবার তাকে ধরে বন্দী করে রেখেছে—তার সঙ্গের জিনিসপত্র কেড়ে নিয়েছে তাঁর লোকজনকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে এমন-কি, তাকে মেরে ফেলবার জন্যও অনেকবার চেষ্টা করেছে। তার উপর সে দেশের অসহ্য গরম আর নানারকম রোগের উৎপাতেও তাকে কম ভুগতে হয় নি। একবার জলের অভাবে তাঁর এত কষ্ট হয়েছিল যে, তিনি গাছের পাতা শিকড় ডাঁটা চিবিয়ে তৃষ্ণা দূর করতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাতে কি তৃষ্ণা যায়? সারাদিন পাগলের মতো জল খুঁজে খুঁজে, সন্ধ্যার কিছু আগে ঘোড়া থেকে নামতে গিয়ে, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। তার পর যখন তাঁর ডান হল তখন তিনি চেয়ে দেখেন, ঘোড়াটা তখনো তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে সূর্য অস্ত গেছে, চারিদিক ক্রমেই অন্ধকার হয়ে আসছে, কাজেই আবার তাঁকে ঘোড়ায় চড়ে জলের সন্ধানে বেরুতে হল। তার পর যখন তাঁর দেহে আর শক্তি নাই, মনে হল প্রাণ বুঝি যায় যায়, তখন হঠাৎ উত্তরদিকে বিদ্যুৎ চমকিয়ে উঠল। তা দেখে তার আবার উৎসাহ ফিরে এল, তিনি বৃষ্টির আশায় সেইদিকে চলতে লাগলেন। চলতে চলতে ক্রমে ঠাণ্ডা বোধ হতে লাগল, বাদলা হাওয়া দেখা দিল তার পর কড়কড় করে বাজ পড়ে ঝমাঝম্ বৃষ্টি নাম। পার্ক তখন তার সমস্ত কাপড় বৃষ্টিতে ধরে দিয়ে, সেই ভিজা কাপড় নিংড়িয়ে তার জল খেয়ে তৃষ্ণা দূর করলেন। তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত্রি, বিদ্যুতের আলোতে কম্পাস দেখে দিক স্থির করে, আবার তাকে সারারাত চলতে হল।

 একবার তিনি সারাদিন না খেয়ে পরিশ্রান্ত হয়ে এক শহরে গিয়ে হাজির হতেই, সেখানকার রাজী হুর দিলেন, “তুমি গ্রামে ঢুকতে পারবে না।” তিনি সেখান থেকে এক গ্রামে গেলেন, সেখানেও লোকেরা তাকে দেখে ভয়ে পালাতে লাগল—তিনি যে

৬৪
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী : ২