পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

রঙের মানুষ দেখলে তাদের ভয় হবারই কথা। কিন্তু তবু বিপদে-আপদে পার্ক তাদের কাছেই সাহায্য পেতেন-মূর বা আরবদের কাছে নয়।

 দেশের নানান স্থানে নানান জাতীয় লোক, তাদের মধ্যে সর্বদাই যুদ্ধ-বিগ্রহ চলে। একবার মাঙ্গো পার্ক মালকোভা বলে একটা শহরে এসে শুনলেন, আরো উত্তরে খুব বড়ো একটা লড়াই চলছে—ফুতা-তরা’র রাজা আবুল কাদের অসভ্য জাফদের রাজা দামেলকে আক্রমণ করেছেন। এই আবুল কাদের আর দামেলের যুদ্ধ বড়ো চমকরি। আবুল কাদের একজন দূতকে দিয়ে দামেলের কাছে দুখানা ছুরি পাঠিয়ে দিলেন, আর বলে দিলেন, “দামেল যদি মুসলমান হতে রাজি হন, তবে এই ছুরি দিয়ে আবুল কাদের নিজের হাতে তার মাথা কামিয়ে দিবেন, আর যদি রাজি না হন তবে ঐ ছুরিটি দিয়ে তাঁর গলা কাটা হবে। এর মধ্যে কোনটি তার পছন্দ?” দামেল এ কথা শুনে বললেন, “কোনোটাই পছন্দ হচ্ছে না। আমি মাথাও কামাতে চাই না, গলায় ছুরিও বসাতে চাই।” আবুল কাদের তখন প্রকাণ্ড দলবল সঙ্গে নিয়ে, জাফদের দেশে লড়াই করতে এলেম। জলিফদের অত সৈন্য-সামন্ত নেই, তারা নিজেদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে, পথের পাতকুয়া সব বন্ধ করে, শহর গ্রাম সব ছেড়ে পালাতে লাগল। এমনি করে তিনদিন পর্যন্ত আবুল কাদের ক্রমাগত এগিয়েও লড়াইয়ের কোনো সুযোগ পেলেন না। তিনি যতই এগিয়ে চলেন, কেবল নষ্ট গ্রাম আর পোড়া শহরই দেখেন, কোথাও জল নাই খাবার কিছু নাই, লুটপাট করবার মতো কোনো জিনিসপত্র নাই। চতুর্থ দিনে তিনি পথ বদলিয়ে সারাদিন হেঁটে একটা জলা জায়গার কাছে এলেন। সেখানে কোনোরকমে তৃষ্ণা দূর করে ক্লান্ত হয়ে সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে, এমন সময় ভোররাত্রে দামেল তাঁর দলবল নিয়ে, মার মার করে তাদের উপরে এসে পড়লেন। আবুল কাদেরের দল সে চোট আর সামলাতে পারল না—তাদের কেউ কেউ পালিয়ে গেল, অনেকে মারা পড়ল, কিন্তু অধি- কাংশই জাফদের হাতে বন্দী হল—সেই বন্দীদের একজন হচ্ছেন আবুল কাদের নিজে। জাফরা মহা ফুর্তিতে আবুল কাদেরকে বেধে দামেলের কাছে নিয়ে গেল। সকলে ভাবল এইবার দামেল বুঝি তাঁর বুকে ছুরি মেরে তার শত্রুতার প্রতিশোধ নেবেন। কিন্তু দামেল সেরকম কিছুই না করে, জিজ্ঞাসা করলেন, “আবুল কাদের, তুমি যথার্থ বল তো –আজি তুমি বন্দী না হয়ে যদি আমি বন্দী হতাম, আর তোমার কাছে আমায় নিয়ে যেত, তা হলে তুমি কি করতে?” আবুল কাদের বললেন, “তোমার বুকে আমার বল্লম বসিয়ে দিতাম। তুমি তার বেশি আর কি করবে?” দামেল বললেন, “তা নয়। তোমায় মেরে আমার লাভ কি? আমার এই-সব নষ্ট ঘরবাড়ি কি তাতে ভালো হয়ে যাবে, আমার প্রজারা কতজনে মারা পড়েছে—তারা কি আবার বেঁচে উঠবে? তোমায় আমি মারব না। তুমি রাজা, কিন্তু রাজার ধর্ম থেকে তুমি পতিত হয়েছ। যতদিন তোমার সে দুর্মতি দূর না হয়, ততদিন তুমি রাজত্ব করবার যোগ্য হবে না—ততদিন তুমি আমার দাসত্ব করবে।” এইভাবে তিন মাস নিজের বাড়িতে বন্দী করে রেখে তার পর তিনি আবুল কাদেরকে ছেড়ে দিলেন। এখনো নাকি সে দেশের লোকেরা দামেলের এই আশ্চর্য মহত্বের কথা বলে গান করে।

৬৬
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী; ২