পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আলোয় মিলাইয়া যায়, পণ্ডিতেরা কত হাজার বৎসর ধরিয়া তাহা দেখিতেছেন তবু তাঁহাদের তৃপ্তি নাই। বছরের কোন সময়ে কোন তারা ঠিক কোনখানে থাকে, কোন তারাটা কতখানি স্থির বা কিরকম অস্থির, তাদের রকমসকম কোনটার কেমন—এই-সবের সূক্ষ হিসাব লইতে লইতে পণ্ডিতদের বড়ো-বড়ো পুঁথি ভরিয়া উঠে। সেই-সব হিসাব ঘাঁটিয়া তাহার ভিতর হইতে কত আশ্চর্য নুতন কথা তাঁহারা বাহির করেন, যাহা সাধারণ লোকের কাছে অদ্ভুত ও আজগুবি শুনায়।

 আজ এক পণ্ডিতের কথা বলিব, তাঁহাকে কেহ বুদ্ধিমান বলিয়া জানিত না, মাস্টারেরা তাহার উপর কোনোদিনই কোনো আশা রাখেন নাই বরং সকলে দুঃখ করিত, 'এ ছেলেটার আর কিছু হইবে না।' অথচ এই ছেলেই কালে একজন অসাধারণ পণ্ডিত হইয়া সমস্ত পৃথিবীতে আপনার নাম রাখিয়া গিয়াছেন। ইহার নাম চার্লস ডারুইন। পড়ার দিকে ডারুইনের বুদ্ধি খুলিত না, একটা বিষয়ে তাহার অসাধারণ অগ্রিহ ছিল। সেটি কেবল নানা অদ্ভুত জিনিস সংগ্রহ করা। শামুক ঝিনুক হইতে আরম্ভ করিয়া, পুরাতন ভাঙা জিনিস বা পাথরের কুচি পর্যন্ত নানা জিনিসে তাঁহার বাক্স ও পড়িবার টেবিল বোঝাই হইয়া থাকিত। বালকের এই আগ্রহটা অন্য লোকের কাছে অন্যায় বাতিক বা উপদ্রব বলিয়াই বোধ হইত, কিন্তু তবু কেহ তাহাতে বড়ো-একটা বাধা দিত না। কারণ, ডারুইনের মনটা স্বভাবতই এমন কোমল এবং তাহার স্বভাব এমন মিষ্ট ছিল যে সকলেই তাহাকে ভালোবাসিত।

 ছেলেবেলায় পড়ার মধ্যে একটি বই ডারুইন খুব মন দিয়া পড়িয়াছিলেন—তাহাতে পৃথিবীর নানা অদ্ভুত জিনিসের কথা ছিল। সেই বই পড়িয়া অবধি তাহার মনে দেশ- বিদেশ ঘুরিবার শখটা জাগিয়া উঠে। কলেজে আসিয়া ডারুইন প্রথমে গেলেন ডাক্তারি শিখিতে। সে সময় ক্লোরোফর্ম ছিল না, তাই রোগীদের সজ্ঞানেই অস্ত্রচিকিৎসার ভীষণ কষ্ট ভোগ করিতে হইত। সেই যন্ত্রণার দৃশ্য দেখিয়া করুণহৃদয় ডারুইনের মন এমন দমিয়া গেল যে, তাঁহার আর ডাক্তারি শেখ হইল না। তখন তিনি ধর্মযাজক হইবার ইচ্ছায় স্কটল্যাণ্ড ছাড়িয়া ইংলণ্ডে ধর্মতত্ত্ব শিখিতে আসিলেন। শিক্ষার দশা এবারও প্রায় পুর্বের মতোই হইল—কারণ, বাল্যকালে তিনি গ্রীক প্রভৃতি যাহা কিছু শিখিয়াছিলেন, এ কয় বছরে তাহার সবই প্রায় ভুলিয়া বসিয়াছেন, ভুলেন নাই কেবল সেই নানা জিনিস সংগ্রহের অভ্যাসটা। কলেজে তাহার সহপাঠী বন্ধুরা দেখিত, ডারুইন সুযোগ পাইলেই মাঠে ঘাটে জঙ্গলে পোকামাকড় সংগ্রহ করিয়া ফিরিতেছেন। হয়তো সারাদিন কোনো পোকার বাসার কাছে পড়িয়া, তাহার চালচলন স্বভাব সমস্ত যারপরনাই মনোযোগ করিয়া দেখিতেছেন। এ বিষয়ে কেবল নিজের চোখে দেখিয়া তিনি এমন সব আশ্চর্য খবর সংগ্রহ করিতেন যাহা কোনো পুঁথিতে পাওয়া যায় না। বন্ধুরা এই-সব ব্যাপার লইয়া নানারকম ঠাট্টা-তামাশা করিত, কেহ কেহ বলিত, “ডারুইন পণ্ডিত হইবে দেখিতেছি।” ডারুইন যে পণ্ডিত হইতে পারেন, এটা কাহারও কাছে বিশ্বাসযোগ্য কথা বলিয়া বোধ হইত না।

 এইরূপে বাইশ বৎসর কাটিয়া গেল। ১৮৩১ খৃস্টাব্দে ‘বীগল' নামে এক জাহাজ

জীবনী
৭৩