পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ফ্রান্সের এক নগণ্য গ্রামের সামান্য এক কৃষকের মেয়ে, তার নাম জোয়ান। সমস্ত দেশের দুঃখ যেন এই মেয়েটির প্রাণে এসে বেজেছিল। ফ্রান্সের লোকজন, ফ্রান্সের? নদী, ফ্রান্সের ঘরবাড়ি সব যেন তার আপনার জিনিস ছিল। ফরাসি বীরদের আশ্চর্য কাহিনী শুনতে শুনতে তার উৎসাহ আগুন হয়ে জ্বলে উঠত, আর ফরাসিদের দুঃখের কথা ভাবতে ভাবতে তার চোখের জল আর ফুরাত না। ফ্রান্সকে সে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। আর ভালোবাসত তার অপনার গ্রামটিকে। সেই মিউজ নদীর ধারে। ছোট্টা ডমরমি গ্রামটি, তার গির্জার গায়ে কত সাধু ‘সেইণ্ট’, কত মহাপুরুষের পাথরমূর্তি। সেখানে সারাদিন গির্জার জানলা দিয়ে রঙিন আলো বাইরে আসে। সেখানে বুড়ো ওক গাছ আছে, আর দেবতার কুয়ো আছে, তাদের সম্বন্ধে কত আশ্চর্য গল্প লোকের কাছে শোনা যায়। জোয়ানের কাছে এ-সমস্তই সুন্দর আর সমস্তই সত্যি বলে মনে হত। সে অবাক হয়ে গির্জার কাছে বাগানে এসে বসে থাকত, আর ভাবত কে যেন তাকে ডাকছে। দেশের দুঃখে সে যখন কাঁদত তখন কে যেন তাকে বলত, ‘ভয় নাই, জোয়ান। তোমার এ দুঃখ আর থাকবে না।’ জোয়ন চেয়ে দেখত কোথাও কেউ নাই, খালি সেট মাইকেলের ঝকঝকে সুন্দর মূর্তিটি যেন তার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে কারা যেন আলোর পোশাক পরে তার কাছ দিয়ে চলে যেত। জোয়ান কিছু বুঝত না, কেবল আনন্দে তার সমস্ত গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত, তার দুচোখ বেয়ে দরদর করে জল পড়ত। এমনি করে কতদিন যায়, একদিন হঠাৎ সে শুনল কে যেন তার নাম ধরে ভাকছে। অতি মধুর অতি সুন্দর গলায় কে যেন বলছে, ‘জোয়ান। দুঃখিনী জোয়ান। ঈশ্বরের প্রিয় কন্যা জোয়ান। তুমি ওঠো। তোমার দেশকে বাঁচাও; রাজপুত্র আমোদেবিলাসে ডুবে আছেন, তাঁকে উৎসাহ দাও; সৈন্যদের মনে নতুন সাহস জাগিয়ে তোল। রাজমুকুট রাজাকে ফিরিয়ে এনে দাও।’ জোয়ান স্তব্ধ হয়ে সব শুনতে লাগল। সে যেন সত্যি সত্যিই দেখল সে আর সেই সামান্য কৃষকের মেয়ে নয়। তার মনে অদ্ভুত সাহস আর শক্তি এসেছে। সে যেন স্পষ্ট দেখতে পেল যে ফ্রান্সের সৈন্য আবার বিপুল তেজে যুদ্ধ করছে, আর সে নিজে অস্ত্র ও পতাকা নিয়ে তাদের আগে আগে চলেছে। এ কী অদ্ভুত কথা। সামান্য চাষার মেয়ে, সে না জানে লেখাপড়া, না জানে সংসারের কিছু, তার উপর একি অসম্ভব আদেশ! কিন্তু জোয়ানের মনে আর কোনো সন্দেহ হল না। সে সকলকে বলল, “আমায় রাজার কাছে নিয়ে চল।” এ কথা যে শোনে সেই হাসে, সেই বলে, “মেয়েটা পাগল।” তার বাবা বললেন, “মেয়েটার বড়ো সাহস বেড়েছে, কোনদিন বিপদ ঘটাবে দেখছি।” গ্রামের যে সর্দার সে বলল, “মেয়েটাকে ঘরে নিয়ে বন্ধ করে রাখ।” গির্জার যে বুড়ো পদরি সেও এসে জোয়ানকে গালাগালি দিয়ে শাসিয়ে গেল। কিন্তু জোয়ান তবু তার সেই এক কথাই বলে, “আমি রাজার কাছে যাব।” যাহোক শেষে জোয়ানের কথাই ঠিক হল। ছদ্মবেশে গ্রাম থেকে বেরিয়ে, কত বাধা বিপদের ভিতর দিয়ে প্রায় আড়াইশো মাইল পথ পার হয়ে একদিন সে সত্যি সত্যিই রাজদরবারে গিয়ে হাজির হল। সেখানে গিয়ে সে রাজার কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, “আমি চাষার মেয়ে জোয়ান। ভগবান আমায় পাঠিয়েছেন শুধু

জীবনী
৮৭