পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এই কথা বলবার জন্য যে, রীমস নগর জয় করে আবার তুমি রাজা হবে।” পাড়াগেঁয়ে চাষার মেয়ে, তার মুখে এমন কথা শুনে সভাসুদ্ধ সকলে হেসে অস্থির। কিন্তু রাজার মুখে হাসি নেই—তিনি জোয়ানের শান্ত মুখের দিকে চেয়ে তার কথা শুনছেন আর তার মনে হচ্ছে—এ মেয়ে বড়ো সামান্য মেয়ে নয়। এ যা বলছে তা সত্যি হবে। তখনই হুকুম হল, “সৈন্যেরা সব প্রস্তুত হও, আবার যুদ্ধে যেতে হবে। ঈশ্বরের দৃত জোয়ান তোমাদের সেনাপতি হবেন।”

 তার পর মহা উৎসাহে সব ফিরে চলল। যেদিকে ইংরাজ সৈন্য গ্রাম নগর সব দখল করে পথঘাট অগিলিয়ে আছে সেইদিকে সবাই চলল। ঝকঝকে সাদা বর্ম পরে যোদ্ধার বেশে চাষার মেয়ে তাদের আগে আগে চলেছে। তার হাতে সাদা নিশান, তার উপর সোনালি কাজ করা যীশুখৃস্টের মূর্তি। চারিদিকের গ্রামবাসীরা এই আশ্চর্য দৃশ্য দেখবার জন্য ছুটে এল—তারা জোয়ানকে ঘিরে আনন্দে কোলাহল করে বলতে লাগল, “দেবতার মেয়ে জোয়ন। দেবতার মেয়ে জোয়ান।” এমনি করে সকলে মিলে অলেয়াঁ শহরে ইংরাজের শিবিরের সামনে উপস্থিত হল। সেইখানে এসে জোয়ান ইংরাজের কাছে এই খবর পাঠাল, “তোমরা আমার কথা শোনো। নগরের চাবি আমার কাছে দিয়ে তোমরা এ শহর ছেড়ে চলে যাও, এ দেশ ছেড়ে তোমাদের দেশে ফিরে যাও। যদি না যাও তবে আমি তোমাদের দুর্গ ভেদ করে যাব অরি চারিদিক এমন তোলপাড় করে তুলব যে হাজার বছর কেউ এ দেশে তেমন কাণ্ড দেখে নি।” ইংরাজ হেসে বললেন, “চাষার মেয়ে, চাষবাস গোরুবাছুর নিয়ে থাক।” কিন্তু জোয়ান তার দলবলসুদ্ধ যখন ইংরাজি শিবির আক্রমণ করলেন, তখন তাঁর অদ্ভুত উজ্জ্বল মুর্তি দেখে ইংরাজের সাহস ও বুদ্ধিব সব যেন আড়ষ্ট হয়ে গেল। কে-বা তখন যুদ্ধ করে, কে-বা ফরাসি সৈন্যের সামনে দাঁড়ায়, দু-একবার মাত্র আক্রমণের বেগ সহ্য করে ইংরাজ সৈন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এক সপ্তাহ মধ্যেই অর্লেয়াঁ শহর উদ্ধার হয়ে গেল। এই সংবাদ যখন দেশময় ছড়িয়ে পড়ল তখন ফরাসিদের মনে কী যে উৎসাহের আগুন জ্বলে উঠল, তার আর বর্ণনা হয় না।

 কিন্তু ফ্রান্সের যাঁরা সেনাপতি ছিলেন, তাঁদের হিংসুকে মনগুলো হিংসায় জ্বলতে লাগল। তারা এতদিন যা করতে পারলেন না, একটা কোথাকার পাড়াগেঁয়ে চাষার মেয়ে কিনা তাই করে দিল। তাঁরা ভিতরে ভিতরে নানারকম শত্রুতা করে জোয়ানের কাজে বাধা দিতে লাগলেন। কিন্তু তারা শত্রুতা করে আর কি করবেন-সৈন্যেরা তখন জোয়ানকেই মানে, দেশের লোক জোয়ানের কথাই শোনে, জোয়ানকে তারা দেবতার মতো ভক্তি করে। এমনি করে জোয়ান গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর উদ্ধার করতে করতে তাঁর সেই পুরানো ডমরেমি গ্রামের কাছে এসে পড়লেন। গ্রামের লোকেরা তখন দল বেঁধে তাদের জোয়ানকে দেখতে চলল। তারা দেখল, ফ্রান্সের সৈন্য আবার উৎসাহ করে যুদ্ধে চলেছে, আবার ফ্রান্সের গৌরবে তাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আর তাদের আগে আগে রাজার সঙ্গে শ্বেত পতাকা নিয়ে আলোর মতো উজ্জ্বল পোশাকে চলেছেন চাষার মেয়ে জোয়ান। যারা আগে জোয়ানকে ঠাট্টা করেছিল, বাধা দিয়েছিল,

৮৮
সুকুমার সমগ্র রচনাবলীঃ২