পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-দ্বিতীয় খণ্ড.djvu/৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

শাসন করতে চেয়েছিল, তারা আজ গর্ব করে বলতে লাগল, “এই তো আমাদের জোয়ান—আমাদের গ্রামের মেয়ে।” আর জোয়ানের বাবা, সেই বৃদ্ধ চাষী যে তার মেয়েকে ডুবে মরবার কথা বলেছিল, আনন্দে তার দুচোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল। সে বলল, “আমার ঘরেও এমন মেয়ে জন্মেছিল।”

 সেনাপতির চলেছেন পদে পদে বাধা দিবার জন্য। এক-একটা শহর জয় হয় আর তাঁরা রাজাকে বলেন, “আর গিয়ে কাজ নাই। হঠাৎ সৈন্যদের একটু উৎসাহ হয়ে কতগুলো শহর দখল করা গেছে। কিন্তু বেশি লোভ করলে, এর পরে ভারি বিপদ হবে।” কিন্তু জোয়ান বলে, “আমি জানি, রীমস্ নগর পর্যন্ত আমায় যেতে হবে, সেখানে রাজার অভিষেক হবে।” যখন রাজার মনও বিমুখ হয়ে পড়ল, তখন জোয়ান কেঁদে বলল, “আর কিছুদিন আমার কথা শুনুন তার পর আমি চলে যাব। শেষে আর সময় হবে না, আমি আর এক বছরের বেশি বাঁচব না।” যখন ক্রয় নগরের কাছে এসে ইংরাজের সৈন্যবল দেখে কাপরুষ রাজা মন্ত্রণা করতে বসলেন, তখন জোয়ান তার মন্ত্রণাসভায় ঢুকে বলল, “এমন করে সময় নষ্ট করবেন না।” সভার মন্ত্রীরা বললেন, “তোমায় ছয়দিনমাত্র সময় দিলাম, এর মধ্যে যদি শহর দখল করতে পার, তা হলে আমরা ফিরে যাব।” জোয়ান বলল, “ছয়দিন কেন? তিনদিন সময় দিন।” তার পরের দিনই সে সৈন্য নিয়ে ত্রয় নগরের দ্বারে উপস্থিত হতেই ইংরাজ প্রহরীরা বিনাযুদ্ধেই দ্বার ছেড়ে পথ ছেড়ে শহর ছেড়ে উত্তরের দিকে সরে পড়ল। তার পর ক্রমে রীমস নগরও উদ্ধার হল। মহা সমারোহ করে রাজার অভিষেক হয়ে গেল, জোয়ান নিজের হাতে রাজার মাথায় মুকুট তুলে দিল। তখন রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, “ফ্রাসের গৌরবমণি জোয়ান। আজ তুমি কি পুরস্কার পেতে ইচ্ছা কর?” জোয়ান বলল, “আমার তো সব ইচ্ছাই পূর্ণ হয়েছে—যদি অনুগ্রহ করতে চান, তবে আমার জন্মস্থান ডমরেমি গ্রামকে আজ থেকে খাজনামুক্ত করে দিন।” সেই থেকে আজ পর্যন্ত। গ্রাম আর সরকারি খাজনা দেয় না—আজও রাজস্ব-হিসাবের খাতায় জোয়ানের নাম করে বলা হয়, তার খাতিরে খাজনা মাপ।

 তার পর জোয়ান বলল, “আমার কাজ এখন শেষ হয়েছে। এখন আমি আমার গ্রামে ফিরে যাই।” কিন্তু সেনাপতিরা উলটা সুর ধরে বললেন, “এতদুর এলাম যখন, তখন পারিস পর্যন্ত যাওয়া যাক।” জোয়ানের মনে এতদিন আশা ছিল, উৎসাহ ছিল, কিন্তু এখন যেন আর তার সে ভরসা নাই। এতদিন তার মনে হত দেবতারা তার সঙ্গে আছেন, অজি প্রথম তার মনে হল সংসারে সে একা—পৃথিবীতে কেউ তার সহায় নেই। তবু রাজার আদেশ মানতে হবে। জোয়ান সৈন্য নিয়ে পারিসের দিকে চললেন। কিন্তু দুদিন না যেতেই অকৃতজ্ঞ নরাধম রাজা গোপনে ইংরাজের সঙ্গে সন্ধি করে, জোয়ানকে শত্রুর মুখে ফেলে নিজে দলবল নিয়ে সরে পড়লেন। জোয়ানের জীবনে এই প্রথমবার তার পরাজয় হল। এমন বিশ্বাসঘাতক কাপুরুষ রাজা, কিন্তু জোয়ান তাকে ছাড়তে পারল না। দুদিন যেতে না যেতেই রাজা আবার বিপদে পড়েছেন। সে খবর শুনেই জোয়ান তাঁর উদ্ধারের জন্য সৈন্য নিয়ে ছুটে গেল। এই তার শেষ যাত্রা।

সু.স.র.-২-১১
৮৯