পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-প্রথম খণ্ড.djvu/১০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

লাল কাচের ঝাপসা ভূতুড়ে আলোয় আবছায়া দেখা যেত, বড়-বড় শাদা চৌকোনা ডিশ, আরো অনেক শিশিবোতল ও যন্ত্রপাতি। এটা ছিল ফোটোগ্রাফির ‘ডার্ক রুম’৷”

 এই পরিবারের আবহাওয়ায় তিনটে স্রোত বইতো: একটা হাসি, খেলা, গান, গল্পের উল্লসিত সহজ স্রোত, আরেকটা জ্ঞানসাধনার, নব নব আবিষ্কারের স্রোত, আর তৃতীয়—নতুন সমাজ ও জাতির তেজস্বী জাগরণের স্রোত। এই পবিত্র ত্রিস্রোতায় অবগাহন করে সহজ প্রতিভাধারী সন্তানসন্ততি বিকশিত হচ্ছিলেন৷


 শৈশব: এই বাড়িতে ১২৯৪ সনের ১৩ কার্তিক (১৮৮৭) সুকুমার রায়চৌধুরীর জন্ম হয়। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়, প্রথম সুখলতা, তৃতীয় পুণ্যলতা, তারপর সুবিনয়, শান্তিলতা ও সুবিমল। সুকুমার ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল ও ফুর্তিবাজ ছিলেন আর তাঁর কৌতূহলও খুব বেশি ছিল। কলের খেলনাগুলোকে ঠুকে ঠকে ভেঙে ভেতরকার রহস্য বের করতে চাইতেন আর বিকেলে ছাতে উঠে ছোট্ট লাঠি হাতে বোর্ডিঙের মেয়েদের তাড়া করে বেড়াতেন৷

 যাঁরা প্রতিভার ভাগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তাঁদের মধ্যে ছোটবেলায় অনেক সময়েই এ প্রাণশক্তির প্রাচুর্য দেখা যায়। তাছাড়া তাঁর প্রতিভার অন্যান্য প্রমাণও তিনি শৈশব থেকেই দিয়েছিলেন। পুণ্যলতা লিখেছেন, “ছোটবেলা থেকেই দাদাও চমৎকার গল্প বলতে পারতো। বাবার প্রকাণ্ড একটা বই থেকে নানা জীবজন্তুর ছবি দেখিয়ে টুনী (শান্তিলতা), মণি (সবিনয়) আর আমাকে অনেক আশ্চর্য আর মজার গল্প বলতো। বইয়ের গল্প ছাড়াও নিজের মনগড়া কত অদ্ভুত জীবের গল্প—মোটা ‘ভবন্দোলা’ কেমন দুলেদুলে থপথপিয়ে চলে, ‘মন্তুপাইন’ তার সরু, লম্বা গলাটা কেমন পেঁচিয়ে, গিঁট পাকিয়ে রাখে, গোলমুখো, ড্যাবাচোখো ‘কোম্পু’ অন্ধকার বারান্দার কোণে, দেয়ালের পেরেকে বাদড়ের মতো ঝুলে থাকে।”—এদেরই আমরা পরে দেখলাম আবোল তাবোল, হযবরল আর হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরিতে।

 শৈশব থেকেই সুকুমার অভিনয় করতে ভালোবাসতেন। প্রথমে তখনকার ছোটদের পত্রিকায় প্রকাশিত ছড়াগল্প নিয়ে আবৃত্তি ও অভিনয় করাতেন। পুণ্যলতা লিখেছেন—“বিকেলে যখন ছাতে অনেক লোক জমা হতো, তখন দুজনে ‘ইঁঁদূর ভায়া’, ‘নাপতে ভায়া’, ‘গণেশবাবু’ ইত্যাদি মজার কবিতা বিচিত্র মুখভঙ্গির সঙ্গে অভিনয় করে সবাইকে হাসাতাম। কতরকম মুখভঙ্গিই যে দাদা করতে পারতো!”

 উপেন্দ্রকিশোর ছবি আঁকতেন আর নিজেদের ছেলেমেয়েদেরও আঁকতে শেখাতেন। প্রত্যেকেরই অল্পবিস্তর হাত থাকলেও সুখলতা আর সুকুমারের হাত সবচেয়ে ভালো ছিল। পরবর্তী জীবনের প্রতিশ্রুতি দেখিয়ে সুখলতার সুন্দর আর সুকুমারের মজার জিনিস আঁকার প্রতি ঝোঁক প্রকাশ পেত। পড়ার বইয়ের খালি পাতাগুলি তিনি মজার ছবি একে ভরিয়ে দিতেন আর শাদাকালো ছবিগুলোয় রঙ দিয়ে দিতেন৷

 রসিকতা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ছিল। মাস্টারমশাই বলেছিলেন নিজের জিনিস গুছিয়ে রাখতে আর ভাইবোনেরা যদি কিছু ছড়িয়ে ফেলে রাখে, তাও তুলে ফেলতে। ছোটবোন টুনী মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে কি যেন করছিলেন, সুকুমার তাঁকে সুদ্ধ তুলে নিয়ে ডেস্কে ভর্তি করলেন।

জীবনী