একবার হাওয়া বদলাতে দার্জিলিঙে গিয়ে তাঁর এক মাসি তাঁকে আদবকায়দা শেখাতে বসলেন। তিনি বিদ্রোহ করলেন, ঝগড়াঝাঁটি করে নয়, অতি বোকা এবং আনাড়ি সেজে সকলকে হাসিয়ে! মাসি যতই ধমকধামক করেন, তিনি ততই হাঁদার মতো মুখ করে ফ্যালফ্যাল করে তাকান, যেন কতই ভয় পেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত মাসিকে সহজ সরল এই পরিবারটিকে সাহেবি রীতিতে দুরস্ত করার পরিকল্পনা ছাড়তে হলো।
মাঘোৎসবের মধ্যে বালক-বালিকা সম্মেলনের ভোজের জন্য ময়রা এক ড্রাম ভর্তি রসগোল্লা নিয়ে এলো। পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, “এই এত রসগোল্লা কে একা খেতে পারে?” কেউ পারে না, তাই সবাই চুপচাপ, সুকুমার জোরে বলে উঠলেন, “আমি পারি!” তারপর ফিস ফিস করে যোগ করলেন, “অনেক দিনে।” শাস্ত্রী মহাশয় খুব হাসলেন—“ইতি গজ নাকি?”
নবদ্বীপচন্দ্র দাস বেজায় মোটা ছিলেন বলে সবাই তাঁকে জালা বলে তামাশা করতো। একদিন তিনি খেতে বসতে যাচ্ছেন, সুকুমার তাড়াতাড়ি তাঁর পিঁড়ির পাশে একটা বিঁড়ে এনে রাখলেন।
সুরমা, হাসি আর খুশি টবে ফুলগাছ লাগিয়েছিলেন। ওঁদের গাছে রঙিন কুঁড়ি ধরলো আর খুশির গাছে শাদা। খুশির তাতে মহা দুঃখ। পরদিন সকালে দেখা গেল খুশির গাছে নানা রঙের কুঁড়ি। তার আনন্দ আর ধরে না, কিন্তু একটু লক্ষ্য করতে ধরা পড়লো মেঝেতে রঙের ছিটে। ভোরবেলায় উঠে সকুমার তুলি নিয়ে তাঁর বোনের গাছের ফলের কুঁড়িগলোকে রাঙিয়ে রেখেছেন।
সহানুভূতি সুকুমারের চরিত্রের অঙ্গ ছিল। তাঁদের পোষা বেড়ালে তাঁদেরই পোষা খরগোসের ছানা খেয়ে ফেলেছে। বেড়ালটাকে কি শাস্তি দেয়া যায় তার আলোচনায় দুঃখের চোটে শিশুমনে যখন নানা হিংস্রতার চিন্তা দানা বাঁধছে তখন সুকুমার দৃঢ়ভাবে বললেন, “না ও-সব শাস্তি দিতে পারবে না, ও কি বোঝে? মরা বাচ্চাগুলো দেখিয়ে ওকে বেশ করে পিট্টি দিয়ে দাও, তাহলেই আর কখনো এরকম করবে না।”
ছোট্ট সকুমারের সাহসের একটা উদাহরণ: এক ছুটিতে ওঁরা মসুয়ায় দেশের বাড়িতে গেছেন। দুপুরবেলা সুকুমার, সুখলতা আর পুণ্যলতা বাইরের পুকুরের নির্জন বাঁধাঘাটে বসে আছেন এমন সময় প্রকাণ্ড লম্বা একটা লোক এসে উপস্থিত, তার হাত রক্তমাখা আর হাতে ধরা লম্বা ছুরি থেকে রক্ত ঝরছে। লোকটিকে ভীষণ দস্যু, ডাকাত ভেবে বোনেরা ভয়ে কেঁপে উঠলেন কিন্তু ছয় বছরের শিশু, সুকুমার এগিয়ে তার পথ আটকে দাঁড়ালেন। পরে অবিশ্যি জানা গেল লোকটি ওঁদেরই বাড়িতে পাঁঠা কেটে পুকুরে হাত ধুতে এসেছিল।
বাড়ির মধ্যেই ইস্কুল ছিল বলে এঁরা খুব তাড়াতাড়ি ভর্তি হয়েছিলেন আর মেয়েদের ইস্কুল হলেও শিশুশ্রেণীতে ভাইবোন, মামামাসি (দ্বারকানাথ গাংগুলির দ্বিতীয় পক্ষের ছেলেমেয়ে) সবাই এক জায়গাতেই পড়তেন। এছাড়া গৃহশিক্ষকও থাকতেন, কিন্তু এদের আসল শিক্ষা হতো বাড়িতে, বাবার কাছে। উপেন্দ্রকিশোর মুখে মুখে গল্পচ্ছলে সহজ বিজ্ঞানের কথা, পথিবীর জন্ম কথা, চাঁদসূর্য, গ্রহনক্ষত্রের কথা, ওঁদের শিখিয়ে দিতেন; দূরবীন দিয়ে আকাশের চাঁদতারা, গ্রহনক্ষত্র দেখাতেন।