শুওর কোথায় গেল রে? ওরে আমার শুওর কে নিল রে?”
বুড়ো তখন বিরক্ত হয়ে পা দুটো ছাড়িয়ে আবার ঠক্ঠক্ করে হেঁটে চলল—আর ঠিক সেই সময়ে বুড়োর গায়ের ছেঁড়া কম্বলের ভেতর থেকে ঘঁৎ ঘঁৎ করে কিসের একটা শব্দ শোনা গেল। লোলি শব্দ শুনেই চিৎকার করে উঠল, “তবে রে হতভাগা চোর! আমাদের শুওর নিয়ে পালাচ্ছিস! এই বলেই সে বুড়োর লাঠিখানা টেনে ধরল। যেমন লাঠিতে হাত দেওয়া, অমনি লোলির মনে হল যেন তার সমস্ত শরীর ঝিম্ ঝিম করছে; তার হাত-পাগুলো সুড়্ সুড়্ করে বেঁকেচুরে কিরকম ছোট্ট হ’য়ে যাচ্ছে; ঘাড় গলা পেট সব অসম্ভব মোটা হয়ে ফুলে উঠছে; মুখটা অদ্ভুতরকম বদলে গিয়ে নাকটাকে ঠেলে এগিয়ে দিচ্ছে! তারপর দেখতে দেখতে সে চারপায়ে হাঁটতে লাগল।
বুড়ো তখন একগাল হেসে বলল, “হ্যাঁ, এইবার ঠিক হয়েছে। কেমন? আগে ছিলি একটা অপদার্থ নিষ্কর্মা ঘুমকাতুরে কুঁড়ে, আর এখন হয়েছিস কেমন থপ্থপে নাদুস্নুদুস্ হ্যাংলামুখো শুওর। বেশ বেশ! আর কোনদিন দুষ্টুমি করবি? আর কখনো বুড়ো মানুষকে ‘চোর’ বলে ধরতে যাবি? যা, এইবার তোর খড়ের গাদায় গিয়ে শুয়ে থাক। তোর বাবা যখন ফিরে আসবে কশাইবুড়োকে নিয়ে, তখন দেখবে শুওরটা আছে, কিন্তু হতভাগা লক্ষ্মীছাড়া লোলিটা কোথায় পালিয়েছে! হোঃ—হোঃ—হোঃ—হোঃ।” বুড়ো খুব একচোট হেসে নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল, আর লোলই রাশটায় ধুলোয় পড়ে কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলে ধুলো ভিজিয়ে কাদা করে ফেলল।
লোলি রাস্তায় পড়ে কাঁদছে, এমন সময় হঠাৎ কোত্থেকে একটা খেঁকি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে আসল। লোলি বেচারা কি করে? সে এখন শুওর হয়ে গেছে, তাই সে তার ভুঁড়ো পেট নিয়ে ছোট-ছোট চারটি পায়ে প্রাণপণে ছুটতে লাগল। ছুটতে ছুটতে হাঁপাতে হাঁপাতে সে নিজেদের বাড়ির ফটকের সামনে এসেই এক দৌড়ে সেই খড়ের গাদার মধ্যে ঢুকে বলল, “ঘঁৎ”—অর্থাৎ “বড্ড বেঁচে গিয়েছি!”
লোলি খড়ের মধ্যে শুয়ে হাঁপাচ্ছে আর ভাবছে, এখন কি করা যায়। এমন সময়ে হঠাৎ ভয়ে তার হাত-পা আড়ষ্ট হয়ে গেল—তার মনে পড়ল, তার বাবা তো সন্ধে হলেই কশাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরবেন, আর তাকেই তো শুয়োর ভেবে কশাইয়ের কাছে বিক্রি করবেন! আর কশাই তাকে একবার পেলেই তো গলায় ছুরি বসিয়ে—! লোলি আর ভাবতে পারে না। সে শুওরের ভাষায় একেবারে “বাপরে মারে! গেছি গেছি!” ব’লে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল। সে ভাবল, এইবেলা সময় থাকতে ছুটে পালাই। কিন্তু পালাবে কোথায়? ঠিক সেই সময়ে তার বাবা সেই কশাইকে নিয়ে ফটক দিয়ে ঢকেছেন। লোলির বাবা ঢুকেই এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন, “দেখছ! হতভাগা ছেলেটা ফটক খোলা রেখেই কোথায় সরে পড়েছে! শুওরটা যে পালায় নি এই ভাগ্যি!” এই বলে তিনি লোলির কান দুটো ধরে কশাইয়ের কাছে টেনে আনলেন। কশাই লোলিকে হাঁ করিয়ে তার মুখ দেখল, তাঁর পাঁজরে খোঁচা মেরে, পিঠের ওপর আচ্ছা করে চাপড়ে তাকে পরীক্ষা করল, তারপর খুশি হয়ে বলল, “হুঁ বেশ।” লোলি তার মাথা নেড়ে হাত-পা ছুঁড়ে লাফাতে লাগল, ক্যাঁচ কোঁচ ঘঁৎ ঘঁৎ কতরকম শব্দ করল, কিন্তু কিছুতেই তার বাবাকে বোঝাতে পারল না যে, সে সত্যি করে শুওর নয়, সে লোলি।