যাচ্ছে, মাঠে মাঠে ঘাস গজাচ্ছে, রোদ উঠছে, বৃষ্টি পড়ছে, পাখিরা গাছে এসে বসছে, আবার সব উড়ে যাচ্ছে। এ-সব চোখের সামনে দেখছি আর হাসি পাচ্ছে!”
মন্ত্রী বললেন—“তা নাহয় বুঝলাম, কিন্তু শুধু বসে বসে হাসলে তো আর মানুষের দিন চলে না। তোমার কি আর কোন কাজকর্ম নেই?”
ফকির বলল—“তা কেন থাকবে না? সকাল বেলায় নদীতে যাই, সেখানে স্নান-টান সেরে, লোকজনের যাওয়া-আসা কথাবার্তা এই সব তামাশা দেখে আবার গাছতলায় এসে বসি। তারপর, যেদিন খাওয়া জোটে খাই, যেদিন জোটে না সেদিন খাই না। যখন বেড়াতে ইচ্ছা হয় বেড়াই, যখন ঘুম পায় তখন ঘুমোই। কোন ভাবনা চিন্তা, হট্টগোল কিছুই নেই। ভারি মজা!”
মন্ত্রী খানিক মাথা চুলকিয়ে বললেন—“যেদিন খাওয়া পাও না সেদিন কি কর?”
ফকির বলল—“সেদিন তো কোন ল্যাঠাই নেই! চুপচাপ পড়ে থাকি আর এইসব তামাশা দেখি। বরং যেদিন খাওয়া হয়, সেদিনই হাঙ্গামা বেশি। ভাত মাখরে, গ্রাস তোলরে, মুখের মধ্যে ঢোকাওরে, চিবোওরে, গেলোরে—তারপর জল খাওরে, আঁচাওরে, হাত মুখ মোছরে! কতরকম কাণ্ড!”
মন্ত্রী দেখলেন, এতদিনে ঠিকমত লোক পাওয়া গিয়েছে। তিনি বললেন— “তোমার গায়ের এক-আধখানা জামা দিতে পার? তার জন্য তুমি যত ইচ্ছা দাম নাও, আমরা দিতে প্রস্তুত আছি।”
শুনে লোকটা হো হো করে হাসতে লাগল, বলল—“আমার আবার জামা। এই সেদিন একটি লোক একটি শাল দিয়েছিল, তাও তো ছাই ভিখারিকে দিয়ে ফেললাম। জামা-টামার ধারই ধারি না কোনদিন।”
মন্ত্রী বললেন—“তা হলে তো মহা মুশকিল! যদি-বা একটা লোক পাওয়া গেল, তারও আবার জামা নেই। আচ্ছা, তোমার বিছানার তোষকখানা দিতে পার? কত দাম চাও বল, আমরা টাকা ঢেলে দিচ্ছি।”
এবারে ফকির হাসতে হাসতে একেবারে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তার হাসি আর থামেই না। অনেকক্ষণ হেসে তারপর সে বলল—“চল্লিশ বছর বিছানাই চোখে দেখলাম না, তা আবার তোষক আর গদি!”
মন্ত্রীমশাই বড়-বড় চোখ করে বললেন—“জামাও গায়ে দাও না, লেপ-কম্বল-বিছানাও সঙ্গে রাখ না, তোমার কি অসুখও করে না ছাই?”
ফকির বলল—“অসুখ আবার কি? অসুখ-টসুখ ও-সব আমি বিশ্বাস করি না। যারা কেবল অসুখ-অসুখ ভাবে, তাদেরই খালি অসুখ করে।”
এই বলে ফকির আবার গাছে হেলান দিয়ে ঠ্যাং মেলে খুব হাসতে লাগল।
মন্ত্রীমশাই হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। রাজার কাছে খবর গেল। রাজা মন্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন, তাঁর কাছে সব কথা শুনলেন, শুনে মন্ত্রীমশাইকে বিদায় দিলেন।
আবার সবাই ভাবতে বসল, এখন উপায় কি হবে? চিকিৎসাও হল না, অনেক কষ্টে যা একটা উপায় পাওয়া গেল, সেটাও গেল ফসকে!
সবাই বসে বসে এ ওর মুখ চায়, দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আর বলে—“নাঃ, আর তো বাঁচাবার উপায় দেখছি না।”