পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-প্রথম খণ্ড.djvu/১৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 রাজকুমারী একেবারে উন্মাদ পাগল হয়ে, বিড় বিড় করে বক্‌তে বক্‌তে, সেই যে ছুটে বেরুলেন, আর বাড়িতে ঢুকলেনই না। তিনি শহরের কাছেই একটা গুহার মধ্যে থাকেন, আর রাস্তা দিয়ে লোকজন যারা চলে তাদের গায়ে ঢিল ছুঁড়ে মারেন! রাজা কত ওঝা বদ্যি ডাকালেন, রাজকুমারীর কোন উপকারই হল না। শেষে রাজা ঢেঁড়া পিটিয়ে দিলেন—“যে রাজকুমারীকে ভাল করতে পারবে, তাকে অর্ধেক রাজত্ব দিব—রাজকুমারীর সঙ্গে বিয়ে দিব।”

 রাজবাড়ীর দরজার সামনে ঘণ্টা ঝুলান আছে, নূতন ওঝা এলেই ঘণ্টায় ঘা দেয়, আর তাকে নিয়ে গিয়ে রাজকুমারীর চিকিৎসা করান হয়। সূদন রম্ভার উপদেশমত বারাণসী গিয়ে রাজকুমারীর পাগল হওয়ার কথা শুনে ঘণ্টায় ঘা দিল। রাজা তাকে ডেকে বললেন—“ওঝার জ্বালায় অস্থির হয়েছি বাপু! তুমি যদি রাজকুমারীকে ভাল করতে না পার, তবে কিন্তু তোমার মাথাটি কাটা যাবে।” এ কথায় সূদন রাজী হয়ে তখনই রাজকন্যার চিকিৎসা আরম্ভ করে দিল।

 ভূতের ওঝারা ভড়ংটা করে খুব বেশি, সূদনও সেসব করতে কসুর করল না। ঘি, চাল, ধূপ, ধুনা দিয়ে প্রকাণ্ড যজ্ঞ আরম্ভ করে দিল, সঙ্গে সঙ্গে বিড়্‌ বিড়্‌ করে হিজি-বিজি মন্ত্র পড়াও বাদ দিল না। যজ্ঞ শেষ করে সকলকে সঙ্গে নিয়ে সেই পর্বতের গুহায় চলল, যেখানে রাজকন্যা থাকে। সেখানে গিয়েও বিড় বিড় করে খানিকক্ষণ মন্ত্র পড়ল—“ভূতের বাপ—ভূতের মা—ভূতের ঝি, ভূতের ছা—দূর দূর দূর, পালিয়ে যা।” ক্রমে সকলে দেখল যে, ওঝার ওষুধে একটু একটু করে কাজ দিচ্ছে। কিন্তু ভূত রাজকুমারীকে একেবারে ছাড়ল না। তিনি তখনও গুহার ভিতরেই থাকেন, কিছুতেই বাইরে আসলেন না। যা হোক, রাজা সূদনকে খুব আদর যত্ন করলেন, আর, যাতে ভূত একেবারে ছেড়ে যায়, সেরূপ ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলেন। দুদিন পর্যন্ত সূদন আরো কত কিছু ভড়ং করল। তৃতীয় দিনে সে রাজার কাছে এসে বলল—“মহারাজ! রাজকুমারীর ভূত বড় সহজ নয়—এ হচ্ছে দৈবী ভূত। মহারাজ যদি এক অসম্ভব কাজ করতে পারেন—বিশ্বেশ্বরের সাতটা মন্দির চুরমার ক’রে, আবার নূতন করে ঠিক আগের মত গড়িয়ে দিতে পারেন,—তবেই আমি রাজকন্যাকে আরাম করতে পারি।”

 রাজা বললেন—“এ আর অসম্ভব কি?” রাজার হুকুমে তখনই হাজার হাজার লোক লেগে গেল। দেখতে দেখতে মন্দিরগুলি চুরমার হয়ে গেল। তারপর এক মাসের মধ্যে আবার সেই সাতটি মন্দির ঠিক যেমন ছিল তেমনটি করে নূতন মন্দির গড়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমারীও সেরে উঠলেন, অপ্সরাও শাপমুক্ত হয়ে স্বর্গে চলে গেল। তারপর খুব ঘটা করে সূদনের সঙ্গে রাজকুমারীর বিয়ে হল আর রাজা বিয়ের যৌতুক দিলেন তাঁর অর্ধেক রাজত্ব।

সন্দেশ—১৩২৭
দেশ-বিদেশের গল্প
১৪৩