তারা দেড় বিঘৎ মানুষ।
তাদের আড্ডা ছিল, গ্রাম ছাড়িয়ে, মাঠ ছাড়িয়ে, বনের ধারে, ব্যাঙ-ছাতার ছায়ার তলায়। ছেলেবেলায় যখন তাদের দাঁত ওঠে নি, তখন থেকে তারা দেখে আসছে, সেই আদ্যিকালের ব্যাঙের ছাতা। সে যে কোথাকার কোন্ ব্যাঙের ছাতা, সে খবর কেউ জানে না, কিন্তু সবাই বলে, “ব্যাঙের ছাতা”।
যত সব দুষ্টু ছেলে রাত্রে যারা ঘমোতে চায় না, মায়ের মুখে ব্যাঙের ছাতার গান শুনে শুনে তাদেরও চোখ বাজে আসে।—
গাল ফোলা কোলাব্যাঙ পাল তোলা রাঙা ছাতা
মেঠোব্যাঙ, গেছোব্যাঙ, ছেঁড়া ছাতা, ভাঙা ছাতা।
সবুজ রঙ জবড়জঙ জরির ছাতা সোনা ব্যাঙ
টোক্কা-আঁটা ফোক্লা ছাতা কোঁকড়া মাথা কোনা ব্যাঙ॥
—কত ব্যাঙের ছাতা!
কিন্তু, আজ অবধি ব্যাঙকে তারা চোখেও দেখে নি। সেখানে, মাঠের মধ্যে ঘাসের মধ্যে, সবুজ সবুজ পাগলা ফড়িঙ থেকে থেকে তুড়ুক্ করে মাথা ডিঙিয়ে লাফিয়ে যায়; সেখানে, রঙ-বেরঙের প্রজাপতি, তারা ব্যস্ত হয়ে ওড়ে ওড়ে আর বসতে চায়, বসে বসে আর উড়ে পালায়; সেখানে, গাছে গাছে কাঠবেড়ালি সারাটা দিন গাছ মাপে আর জরিপ করে, গাছ বেয়ে ওঠে আর গাছ বেয়ে নামে। আর রোদে বসে গোঁফ তাওয়ায় আর হিসেব কষে। কিন্তু তারাও কেউ ব্যাঙের খবর বলতে পারে না।
গ্রামের যত বুড়োবুড়ি, দিদিমা আর ঠাকুরমা, তাঁরা বলেন, আজও সে ব্যাঙ মরে নি, তার ছাতার কথা ভোলে নি।
যখন ভরা বর্ষায় বাদল নামে, বন-বাদাড়ে লোক থাকে না, ব্যাঙ তখন আপন ছাতার তলায় বসে মেঘের সঙ্গে তর্ক করে। যখন নিশুত রাতে সবাই ঘুমোয়, কেউ দেখে না, তখন ব্যাঙ এসে তার ছাতার ছায়ায় ঠ্যাঙ ছড়িয়ে বুক ফুলিয়ে তান জড়ে দেয়, “দ্যাখ্ দ্যাখ্ দ্যাখ্, এখন দ্যাখ।” কিন্তু যেদিন সব দুষ্টু ছেলে জট্লা করে বাদলায় ভিজে দেখতে গেল, কই তারা তো কেউ ব্যাঙ দেখে নি? আর যেবার তারা নিঝম রাতে ভরসা করে বনের ধারে কান পেতেছে, সেবারে তো কই গান শোনে নি!
কিন্তু ছাতা যখন আছে, ব্যাঙ তখন না এসে যাবে কোথায়? একদিন না একদিন ব্যাঙ ফিরে আসবেই—আর বলবে, “আমার ছাতা কই?” তখন তারা বলবে, “এই যে তোমার আদ্যিকালের নতুন ছাতা—নিয়ে যাও। আমরা ভাঙি নি, ছিঁড়ি নি, নষ্ট করি নি, নোঙরা করি নি, খালি ওর ছায়ায় বসে গল্প করেছি।”—কিন্তু ব্যাঙও আসে না, ছাতাও সরে না, ছায়াও নড়ে না, গল্পও ফুরোয় না।