ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছে এমনি রোখ করে চলতে লেগেছে, যে ভয়ে ব্যাঙের প্রাণ তো যায় যায়! হঠাৎ কোত্থেকে কার একটা লাঠি না ছাতা না কিসের গুঁতো এসে এমনি ধাঁই করে ব্যাঙের গায়ে লেগেছে যে সে বেচারা ঠিকরে গিয়ে পথের ধারে ঘাসের ওপর চিৎপাত হয়ে পড়েছে।
ব্যাঙ বুড়োর খুব লেগেছিল, কিন্তু হাতও ভাঙে নি, পাও ভাঙে নি, সে আস্তে আস্তে উঠে বসল—আর চারিদিকে তাকিয়ে, দেয়ালের গায়ে একটা ফাটল দেখে, তাড়াতাড়ি তার মধ্যে ঢুকে পড়ল। সেখান থেকে খুব সাবধানে মুখ বার করে সে চেয়ে দেখল, মাথায়-মুকুট রঙিন-পোশাক রাজা, আলো ঝলমল চতুর্দোলায় চড়ে সভায় যাচ্ছেন। লোকেরা সব “রাজা, রাজা” বলে নমস্কার করছে, নাচছে, গাইছে আর ছুটোছুটি করছে। আর রাজামশাই চতুর্দোলায় বসে খুশি হয়ে, এর দিকে তাকাচ্ছেন, ওর দিকে তাকাচ্ছেন, আর কেবলি হাসছেন। তাই দেখে ব্যাঙের বড় ভালো লাগল, সেও দু হাত তুলে নমস্কার করতে লাগল আর বলতে লাগল, “রাজা রাজা রাজা—রাজা রাজা রাজা!” তার মনে হল রাজামশাই ঠিক যেন তার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেললেন! ব্যাঙ তখন কাঁদ-কাঁদ হয়ে নিশবাস ফেলে ভাবল, ‘আহা! আমাদের যদি একটা রাজা থাকত!’
তারপর ঘরে ঘরে পথ খুঁজে খুঁজে ব্যাঙ যখন বাসায় ফিরল, তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সবাই বলল, “সর্দার বুড়ো, সর্দার বুড়ো সারাদিন তুমি কোথায় ছিলে? আমরা যে কত ডাকলাম, কত খুঁজলাম, তুমি তো কই সাড়াও দিলে না।” সর্দার বলল—“চোপ্ চোপ্ চোপ্ রাও! রাজা দেখতে গিয়েছিলাম।” তাই শুনে ব্যাঙেরা সব এক সঙ্গে “রাজা কে ভাই?” “রাজা কে ভাই?” “রাজা কে ভাই?” বলে চেঁচিয়ে উঠল। বুড়ো তখন গাল ফুলিয়ে, বুক ফুলিয়ে দুচোখ বুজে, দুহাত তুলে লাফিয়ে বলল, “রাজা হচ্ছে এই এত্তো বড়ো উঁচু, আর ধবধবে সাদা আর ঝক্ঝকে আলোর মতো—আর তাকে দেখলেই সবাই মিলে ডাকতে থাকে—“রাজা রাজা রাজা রাজা।” তাই শুনে ব্যাঙেরা সবাই বলতে লাগল, “আহা! আহা! আমাদের যদি একটা রাজা, থাকত!” তাদের যে রাজা নেই এই কথা ভাবতে ভাবতে তাদের চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়তে লাগল। বুড়ো ব্যাঙ বলল, “ভাই সকল, এসো আমরা রাজার জন্য দরখাস্ত করি।” তখন সবাই মিলে গোল হয়ে বসে, আকাশের দিকে চোখ তুলে, নানান সুরে ডাকতে লাগল—“রাজা রাজা রাজা রাজা—রাজা রাজা রাজা রাজা—রাজা চাই রাজা চাই—রাজা চাই রাজা চাই।”
ব্যাঙ পাকুরের ব্যাঙ-দেবতা—যিনি বাদলা দিনে বর্ষা মেঘের ঝাঁঝরি দিয়ে পুকুর ভরে জল ঢালেন—তিনি তখন আকাশতলায় চাদর মেলে ঘুমোচ্ছিলেন। হঠাৎ ব্যাঙেদের চিৎকারে তাঁর ঘুম ভাঙল। তিনি চারদিকে তাকিয়ে বললেন, “বৃষ্টিও নেই, বাদলাও নেই, মেঘের কোন চিহ্নও নেই, বাছারা সব চেঁচাও কেন” ব্যাঙেরা বলল, “আমাদের রাজা নেই, রাজা চাই।” দেবতা বললেন, “এই নে রাজা।” বলে মরা গাছের একখানা ডাল ভেঙে তাদের সামনে ফেলে দিলেন।
ভাঙা ডাল পাকুরপাড়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল—তার মাথার ওপর মস্ত মস্ত ব্যাঙের ছাতা জোছ্নায় চকচক করতে লাগল। তাই দেখে ব্যাঙেদের ফুর্তি আর ধরে না। তারা গোল হয়ে ঘিরে বসে মনের সুখে গাল ফুলিয়ে গাইতে লাগল—“রাজা রাজা রাজা রাজা—রাজা রাজা রাজা রাজা—”