ডিঙিয়েছ। আবার ওঠো। মনে থাকে যেন, একটুও লাফাবে না, একটাও সিঁড়ি ডিঙোবে না।” এতটা সিঁড়ি উঠে নেমে যতীন বেচারির পা টনটন করছিল। সে এবার আস্তে আস্তে ওপরে উঠল, আস্তে আস্তে নেমে এল। তারা বলল,”আচ্ছা, এবার মন্দ হয় নি। তা হলে চল দর্জির কাছে।”
এই বলে তারা তাকে আরেকটা মাঠে নিয়ে গেল, সেখানে খালি দর্জিরা বসে সেলাই করছে। যতীনকে দেখেই তারা জিগ্গেস করল, “কি? কি ছিঁড়েছ?” মুচিরা উত্তর দিল, “নতুন ধুতিটা দেখ কতটা ছিঁড়ে ফেলেছে।” দর্জিরা মাথা নেড়ে বলল, “বড় অন্যায়, বড় অন্যায়! শিগ্গির সেলাই কর।” যতীনের আর না বলবার সাহস হলো না। সে ছুঁচসুতো নিয়ে ছেঁড়া কাপড় জুড়তে বসে গেল। সবেমাত্র দু-এক ফোঁড় দিয়েছে, অমনি দর্জিরা চেঁচিয়ে উঠল, “ওকে কি সেলাই বলে? খোলো, খোলো!” অমনি করে, বেচারি যতবার সেলাই করে, ততবার তারা বলে, “খোলো, খোলো।” শেষে সে একেবারে কেঁদে ফেলে বলল, “আমার বড্ড ঘুম পেয়েছে, বড্ড খিদে পেয়েছে। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও, আর আমি কখনো কাপড় ছিঁড়ব না, জুতো ছিঁড়ব না।” তাতে দর্জিরা হাসতে হাসতে বলল, “খিদে পেয়েছে? তা তোমার খাবার জিনিস তো আমাদের কাছে ঢের আছে,” এই বলে তারা তাদের কাপড়ে দাগ দেবার পেনসিল কতগুলো এনে দিল, “তুমি তো পেনসিল চিবোতে ভালোবাস, এইগুলো চিবিয়ে খাও, আর কিছু আমাদের কাছে নেই।”
এই বলে তারা যার যার কাজে চলে গেল। শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে যতীন মাটিতে শুয়ে পড়ল। এমন সময়ে আকাশে বোঁ বোঁ করে কিসের শব্দ হল, আর যতীনের তালি দেওয়া সাধের ঘুড়িটা গোঁৎ খেয়ে এসে তার কোলের ওপর পড়ল। ঘুড়িটা ফিসফিস করে বলল, “তুমি আমাকে যত্ন করেছ, তাই আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি। শিগ্গির আমার ল্যাজটা ধর।” যতীন তাড়াতাড়ি ঘুড়ির ল্যাজ ধরল। ঘুড়িটা আমনি তাকে নিয়ে সোঁ করে আকাশে উঠে গেল। সেই শব্দ শুনে দর্জিরা বড়-বড় কাঁচি নিয়ে ছুটে এল ঘুড়ির সুতোটা কেটে দিতে। হঠাৎ ঘুড়ি আর যতীন জড়াজড়ি করে নীচের দিকে পড়তে লাগল। পড়তে পড়তে যেই মাটিটা ধাঁই করে যতীনের মাথায় লাগল, অমনি সে চমকে উঠল। ঘুড়িটা কি হল কে জানে! যতীন দেখল সে সিঁড়ির নীচে শুয়ে আছে, আর তার মাথায় ভয়ানক বেদনা হয়েছে।
কিছুদিন ভুগে যতীন সেরে উঠল। তার মা বলতেন, “আহা, সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে, এই ভোগানিতে বাছা আমার বড় দুর্বল হয়ে গেছে। সে স্ফূর্তি নেই, সে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চলা নেই, কিছুই নেই। তা নইলে একজোড়া জুতো চার মাস যায়?”
আসল কথা—যতীন এখনো সেই মুচিদের আর দর্জিদের কথা ভুলতে পারে নি।