দুইজনে যাত্রার আসরে গিয়া বসিল। রাত দুপুর পর্যন্ত নাচগান চলিল, তারপর অন্ধ বলিল, “বন্ধু, গান শুনিলে কেমন?” কালা বলিল, “আজকে তো নাচ দেখিলাম—গানটা বোধহয় কাল হইবে।” অন্ধ ঘন ঘন মাথা নাড়িয়া বলিল, “মূর্খ তুমি! আজ হইল গান—নৃত্যটাই বোধহয় কাল হইবে।”
কালা চটিয়া গেল। সে বলিল “চোখে দেখ না, তুমি নাচের মর্ম জানিবে কি?” অন্ধ তাহার কানে আঙুল ঢুকাইয়া বলিল, “কানে শোন না, গানের তুমি কাঁচকলা বুঝিবে কি?” কালা চিৎকার করিয়া বলিল, “আজকে নাচ, কালকে গান”, অন্ধ গলা ঝাঁকড়াইয়া আর ঠ্যাং নাচাইয়া বলিল, “আজকে গান, কালকে নাচ।”
সেই হইতে দুজনের ছাড়াছাড়ি। কালা বলে, “অন্ধটা এমন জুয়াচোর—সে দিনকে রাত করিতে পারে।” অন্ধ বলে, “কালাটা যদি নিজের কথা শুনিতে পাইত, তবে বুঝিত সে কতবড় মিথ্যাবাদী।”
(২)
কলকেতার সাহেববাড়ি থেকে গোষ্ঠবাবুর ছবি এসেছে। বাড়িতে তাই হুলুস্থূল। চাকর বামুন ধোপা নাপিত দারোগা পেয়াদা সবাই বলে, “দৌড়ে চল, দৌড়ে চল।”
যে আসে সেই বলে, “কি চমৎকার ছবি। সাহেবের আঁকা।” বুড়ো যে সরকারমশাই, তিনি বললেন, “সব চাইতে সুন্দর হয়েছে বাবুর মুখের হাসিটুকু— ঠিক তাঁরই মতন ঠাণ্ডা হাসি।” শুনে অবাক হয়ে সবাই বলল, “যা হোক! সাহেব হাসিটুকু ধরেছে খাসা।”
বাবুর যে বিষ্টুখুড়ো তিনি বললেন, “চোখদুটো যা এঁকেছে, ওরই দাম হাজার টাকা—চোখ দেখলে, গোষ্ঠর ঠাকুরদার কথা মনে পড়ে।” শনে একুশজন একবাক্যে হাঁ-হাঁ করে সায় দিয়ে উঠলো।
রেধো ধোপা তার কাপড়ের পোঁটলা নামিয়ে বলল, “তোফা ছবি। কাপড়খানার ইস্ত্রি যেন রেধো ধোপার নিজের হাতে করা।” নাপিত তার খুরের থলি দুলিয়ে বলল, “আমি উনিশ বছর বাবুর চুল ছাঁটছি—আমি ঐ চুলের কেতা দেখেই বুঝতে পারি, একখানা ছবির মতন ছবি। আমি যখনই চুল ছাঁটি, বাবু আয়না দেখে ঐরকম খুশি হন।”
বাবর আহ্লাদী চাকর কেনারাম বলল, “বলব কি ভাই, এমন জলজ্যান্ত ছবি—আমি তো ঘরে ঢুকেই এক পেনাম ঠুকে চেয়ে দেখি, বাবু তো নয়—ছবি।” সবাই বলল, “তা ভুল হবারই কথা—আশ্চর্য ছবি যা হোক।”
তারপর সবাই মিলে ছবির নাকমুখ, গোঁফদাড়ি, সমস্ত জিনিসের খুব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম আলোচনা করে প্রমাণ করলেন যে সব বিষয়েই বাবুর সঙ্গে আশ্চর্য রকম মিলে যাচ্ছে—সাহেবের বাহাদুরি বটে! এমন সময় বাবু এসে ছবির পাশে দাঁড়ালেন।
বাবু বললেন, “একটা বড় ভুল হয়ে গেছে। কলকেতা থেকে ওরা লিখছে যে