পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-প্রথম খণ্ড.djvu/২১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আর রামার পাঁচসিকা—দুইজনের পয়সা মিলাইয়া কুকুর কেনা হইল। সুতরাং দুইজনেই কুকুরের মালিক।

 কুকুরটাকে বাড়িতে আনিয়াই ভজা বলিল,”অর্ধেকটা কুকুর আমার, অর্ধেকটা তোর।” রামা বলিল, “বেশ কথা! মাথার দিকটা আমার, ল্যাজের দিকটা তোর।” ভজু একটু ভাবিয়া দেখিল, মন্দ কি! মাথার দিকটা যাহার সেই তো কুকুরকে খাওয়াইবে, যত হাঙ্গাম সব তাহার। তাহা ছাড়া কুকুর যদি কাহাকেও কামড়ায়, তবে মাথার দিকের মালিকই দায়ী, ল্যাজের মালিকের কোন দোষ দেওয়া চলিবে না। সুতরাং সে বলিল, “আচ্ছা, ল্যাজের দিকটাই নিলাম।”

 দুইজনে দুপুরবেলায় বসিয়া কুকুরটার পিঠে হাত বুলাইয়া তোয়াজ করিত। রামা বলিত, “দেখিস, আমার দিকে হাত বোলাস নে।” ভজু বলিত, “খবরদার, এদিকে হাত আনিস নে। দুইজনে খুব সাবধানে নিজের নিজের ভাগ বাঁচাইয়া চলিত। যখন ভজুর দিকের পা তুলিয়া কুকুরটা রামার দিকে কান চুলকাইত, তখন ভজু খুব উৎসাহ করিয়া বলিত “খুব দে—আচ্ছা করে খামচে দে।” আবার ভজুর দিকে মাছি বসিলে রামার দিকের মুখটা যখন সেখানে কামড়াইতে যাইত, তখন রামা আহ্লাদে আটখানা হইয়া বলিত, “দে কামড়ে! একেবারে দাঁত বসিয়ে দে।”

 একদিন একটা মস্ত লাল পিঁপড়া কুকুরের পিঠে কামড়াইয়া ধরিল। কুকুরটা গা ঝাড়া দিল, পিঠে জিভ লাগাইবার চেষ্টা করিল। নানারকম অঙ্গভঙ্গি করিয়া পিঠটাকে দেখিবার চেষ্টা করিল। তাহার পর কিছুতেই কৃতকার্য না হইয়া কেঁউ কেঁউ করিয়া কাঁদিতে লাগিল। তখন দুইজনে বিষম তর্ক উঠিল, কার ভাগে কামড় পড়িয়াছে। এ বলে, “তোর দিকে পিঁপড়ে লেগেছে—তুই ফেলবি” ও বলে, “আমার বয়ে গেছে পিঁপড়ে ফেলতে—তোর দিকে কাঁদছে, সে তুই বুঝবি।” সেইদিন দুইজনে প্রায় কথাবার্তা বন্ধ হইবার জোগাড়।

 তাহার পর একদিন কুকুরের কি খেয়াল চাপিল, সে তাহার নিজের ল্যাজটা লইয়া খেলা আরম্ভ করিল। নেহাৎ ‘কুকুরে’ খেলা—তাহার না আছে অর্থ, না আছে কিছু। সে ধনুকের মতো একপাশে বাঁকা হইয়া ল্যাজটার দিকে তাকাইয়া দেখে আর একটু, একটু, ল্যাজ নাড়ে। সেটা যে তাহার নিজের লাজ, সে খেয়াল বোধহয় তাহার থাকে না তাই হঠাৎ অতর্কিতে ল্যাজ ধরিবার জন্য সে বোঁ করিয়া ঘুরিয়া যায়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীরটাও নড়িয়া যায়, কাজেই ল্যাজটা আর ধরা হয় না। ভজু আর রামা এই ব্যাপার দেখিয়া উৎসাহে পাল্লা দিয়া চিৎকার করিতে লাগিল। রামার মহা স্ফুর্তি যে ভজুর ল্যাজকে তাড়া করা হইতেছে, আর ভজুর ভারি উৎসাহ যে তাহার ল্যাজ রামার মুখকে ফাঁকি দিয়া নাকাল করিতেছে।

 দুইজনের চিৎকারেই হউক কি নিজের ঢ্যাঁটামির জন্যই হউক, কুকুরটার জিদ চড়িয়া গেল। সমস্তদিন সে থাকিয়া থাকিয়া চরকিবাজির মতো নিজের ল্যাজকে তাড়া করিয়া ফিরিতে লাগিল। এই রকমে খামাখা পাক দিতে দিতে কুকরটা যখন হয়রান হইয়া হাঁফাইতে লাগিল, তখন রামা ব্যস্ত হইয়া উঠিল। ভজা বলিল, “আমার দিকটাই জিতেছে।”

 কিন্তু কুকুরটা এমন বেহায়া, পাঁচমিনিট যাইতে না যাইতেই সে আবার ল্যাজ তাড়ানো শুরু করিল। তখন রামা রাগিয়া বলিল, “এইও তোমার ল্যাজ সামলাও। দেখছ না কুকুরটা হাঁপিয়ে পড়েছে।” ভজু বলিল, “সামলাতে হয় তোমার দিক

নানা গল্প
২০৭