পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-প্রথম খণ্ড.djvu/২১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সামলাও—ল্যাজের দিকে তো আর হাঁপাচ্ছে না!” রামা ততক্ষণে রীতিমত চটিয়াছে। সে কুকুরের পিছন পিছন গিয়া ধাঁই করিয়া এক লাথি লাগাইয়া দিল। ভজু বলিল, “তবে রে! আমার দিকে লাথি মারলি কেন রে?” এই বলিয়াই সে কুকুরের মাথায় ঘাড়ে কানে চটাপট কয়েকটা চাঁটি লাগাইয়া দিল। দুইদিক হইতেই রেষারেষির চোটে কুকুরটা ছুটিয়া পালাইল। তখন দুইজনে বেশ একচোট হাতাহাতি হইয়া গেল।

 পরের দিন সকালে উঠিয়াই রামা দেখে, কুকুরটা আবার ল্যাজ তারা করিতেছে। তখন সে কোথা হইতে একখানা দা আনিয়া এক কোপে ক্যাঁচ করিয়া ল্যাজের খানিকটা এমন পরিপাটি—উড়াইয়া দিল যে কুকুরটার আর্তনাদে ভজু ঘুমের মধ্যে লাফ দিয়া একেবারে বাহিরে আসিয়া উপস্থিত। সে আসিয়াই দেখিল কুকুরের ল্যাজ কাটা, রামার হাতে দা। ব্যাপারটা বুঝিতে তাহার বাকি রহিল না।

 তখন সে রামাকে মারিতে মারিতে মাটিতে ফেলিয়া তাহার উপর কুকুর লেলাইয়া দিল। কুকুরটা ল্যাজ কাটার দরুন রামার উপর একটুও খুশি হয় নাই—সে নিমকহারাম হইয়া ‘রামার দিক’ দিয়াই রামার ঠ্যাঙে কামড়াইয়া দিল।

 এখন দুইজনে চায় থানায় নালিশ করিতে। রামা বলে, “ল্যাজটা ভারি বেয়াড়া, বারবার মুখের সঙ্গে ঝগড়া বাধাইতে চায়—তাই সে ল্যাজ কাটিয়াছে। ল্যাজ না কাটিলে কুকুর পাগল হইয়া যাইত, নাহয় সর্দিগর্মি হইয়া মরিত। মারা গেলে তো সমস্তটা কুকুরই মারা যাইত, সতরাং ল্যাজ কাটার দরুন গোটা কুকুরটারই উপকার হইয়াছে। মুখও বাঁচিয়াছে, ল্যাজও বাঁচিয়াছে; তাহাতে রামারও ভালো, ভজুরও ভালো। কিন্তু ভজুর এতবড় আস্পর্ধা যে সে রামার দিকের কুকুরকে রামার উপর লেলাইয়া দিল। মুখের দিকে ভজুর কোন দাবিদাওয়া নাই, সে দিকটা সম্পূর্ণভাবেই রামার—সুতরাং রামার অনুমতি ছাড়া ভজু কোন্‌ সাহসে এবং কোন্‌ শাস্ত্র বা আইনমতে তাহা লইয়া পরের ধনে পোদ্দারি করিতে যায়? ইহাতে অনধিকারচৰ্চা, চুরি, তছরুপ—সবরকম নালিশ চলে।

 ভজু কিন্তু বলে অন্যরকম। সে বলে রামার দিকের কুকুর রামাকে কামড়াইয়াছে, তাহাতে ভজুর কি দোষ? ভজু কেবল ‘লে লে লে’ বলিয়াছিল; তাহাতে কুকুর যদি রামাকে কামড়ায়, তবে সেটা তাঁহার শিক্ষার দোষ—রামা তাহাকে ভালো করিয়া শিক্ষা দেয় নাই কেন? তাহা ছাড়া ভজুর ল্যাজ খেলা করিতে চায়, রামার হিংসুটে মুখটা তাহাতে আপত্তি করে কেন? ভজর ল্যাজকে কামড়াইতে যাইবার তাহার কি অধিকার আছে? আর রামা তাহার কুকুরের চোখ বাঁধিয়া কিংবা মুখোস আঁটিয়া দিলেই পারিত—সে ল্যাজ কাটিতে গেল কাহার হুকুমে? একবার নালিশটি করিলে রামচরণ ‘বাপ বাপ’ বলিয়া ছয়টি মাস জেল খাটিয়া আসিবেন—তাহা না হইলে ভজুর নাম ভজহরিই নয়।

 এখন এ তর্কের আর মীমাংসাই হয় না। আমাদের হরীশখুড়ো বলিয়াছিলেন, “এক কাজ কর, কুকুরটার নাকের ডগা থেকে ল্যাজের আগা পর্যন্ত দাঁড়ি টেনে তার ডান দিকটা তুই নে, বাঁ দিকটা ওকে দে—তা হলেই ঠিকমত ভাগ হবে।” কিন্তু তাহারা ঐরকম “ছিলকা কুকুরের” মালিক হইতে রাজি নয়। কেউ কেউ বলিল, “তা কেন? ভাগাভাগির দরকার কি? গোটা কুকুরটাই রামার, আবার গোটা কুকুরটাই ভজুর।” কিন্তু এ কথায়ও তাহাদের খুব আপত্তি। একটা বই কুকুর নাই তার গোটা কুকুরটাই যদি রামার হয়, তবে ভজর আবার কুকুর আসে কোথা হইতে?

২০৮
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী