পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-প্রথম খণ্ড.djvu/২২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সন্ধ্যার সময়ে ঘরের মধ্যে বসে আছি। ঘরেও বাতি জ্বালা হয় নি, বাইরেও বেশ অন্ধকার। খালি সরু নখের মতো একটুখানি চাঁদ সবেমাত্র পুবদিকে উঁকি দিয়েছে; এমন সময়ে মনে হলো যেন একটা মানুষ দেয়াল বেয়ে বেয়ে বাড়ির ছাদের ওপর উঠছে—”

 বৃন্দাবনবাবু সবে এইটুকু বলেছেন, এমন সময়ে বারান্দায় কে ডাক দিল, “বাবু, টেলিগ্রাম।” রামবাবু তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে টেলিগ্রামখানা নিয়ে আসলেন, তারপর চোখের চশমাটি কপালে তুলে টেলিগ্রামখানা খুলে পড়তে লাগলেন। পড়তে পড়তে তাঁর চোখ ক্রমেই গোল হয়ে উঠছে দেখে ডাক্তারবাব জিগ্‌গস করলেন, “কি, ব্যাপারখানা কি?” রামবাবু ধপাস করে সোফার ওপর বসে পড়ে বললেন, “এই দেখুন না, দেশ থেকে পরেশ টেলিগ্রাম করছে—সিরিয়স একসিডেণ্ট, কাম হোম ইমিডিয়েটলি’— (অর্থাৎ গুরুতর দুর্ঘটনা, শীঘ্র বাড়ি আসুন)।” রামবাবুর তিন ছেলে কয়দিন হলো পুজোর ছুটিতে দেশে গেছে, আর একটি মামাবাড়িতে আছে, আর বাকি তিনটি বাড়িতেই মায়ের কাছে রয়েছে। রামবাবু বললেন, “এত লোক থাকতে পরেশ ছোকরাটাকে দিয়েই-বা টেলিগ্রাম করাতে গেল কেন? দুটো পয়সা খরচ করে বড়রা কেউ একটু ভালো করে গুছিয়ে টেলিগ্রাম করলেই পারত। এখন যে কি করি? আজ বিষ্যুৎবার, এ সময়ে রওনাই-বা হই কেমন করে, কিছুই তো বুঝতে পারছি না।” তিনি চাকরকে ডেকে তিনতলার বড় ঘর থেকে তাঁর কলমটা আনতে বললেন, আর বললেন, “একটা টেলিগ্রাম করে দেখা যাক কি জবাব আসে।” এই বলে তিনি আবার টেলিগ্রামখানা পড়তে লাগলেন।

 গল্পগুজব তো চুলোয় গেল, সবাই মিলে ভাবতে বসলো এখন কি করা যায়। এমন সময়ে রামবাবু হঠাৎ বলে উঠলেন, “ও কি! এ কার টেলিগ্রাম? এ তো দেখছি ‘রমাপদ সেন’ লেখা। আমার কি যে চোখ হয়েছে, আমি পড়ছি রমাপ্রসাদ সান্ন্যাল।” বলতেই পোস্টমাস্টার প্রিয়শঙ্করবাবু বলে উঠলেন, “ও! রমাপদ যে ও-পাড়ার গুপীবাবুর ভাই; আমি জানি তার শ্বশুরের নাম পরেশনাথ কি যেন।” তখন খুব একটা হাসির ধুম পড়ে গেল।

 রামবাবু বললেন, “দেখলেন মশাই, পিওনব্যাটার কাণ্ড! এক ভুল টেলিগ্রাম দিয়ে আমায় মেরেছিল আর কি! একে বুড়ো বয়স তাতে আবার, জানেন তো, আমার হার্টের ব্যারাম আছে।” হেডমাস্টার যতীশবাবু শুনে হেসে বললেন, “আপনি আবার এর মধ্যেই বুড়ো হলেন কি করে?” রামবাবু বললেন, “বিলক্ষণ! এ পাড়ায় আমার মতন বুড়ো আর কটি খুঁজে পান দেখুন তো! এই আষাঢ় মাসে আমি ষাটের কোঠায় পা দিয়েছি।” বৃন্দাবনবাবু বললেন, “তা হলে আমার জ্যাঠামশায়ের কাছে আপনার হার মানতে হল। তাঁর বয়স উনসত্তর।” ডাক্তারবাবু বললেন, “আমারও বড় কম হয় নি, চৌষট্টি পার হয়ে গেছে। কিন্তু এ পাড়ায় বয়সের জন্য যদি প্রাইজ দিতে হয়, তা হলে ভোলানাথের বাপকেই দেওয়া উচিত; তাঁর নাকি এখন আটাত্তর বছর চলছে।” এইরকম বাজে কথা চলছে, এমন সময়ে বড়-বড় বারকোশের ওপর থালা সাজিয়ে রামবাবুর তিনটি চাকর খাবার নিয়ে হাজির। কচুরি, নিমকি, সন্দেশ থেকে পিঠে পায়স পর্যন্ত প্রায় বারো-চোদ্দ রকমের খাবার। ডাক্তার বললেন, “বাপ রে! এ যে বিরাট আয়োজন। ব্যাপারখানা কি?” রামবাবু বললেন, “ঐ যা! আসল কথাই বলতে ভুলে গেছি। আজ আমার জামাই এসেছেন, তাই বাড়িতে একটু

২১৬
সুকুমার সমগ্র রচনাবলী