উপুড় হয়ে শুয়ে, কখনো-বা তাতে পিঠ দিয়ে আধবসা হয়ে ড্রইং বোর্ডের ওপর সরঞ্জাম নিয়ে লিখতেন, আঁকতেন। লোকে দেখা করতে এলে বোর্ডটি পাশে সরিয়ে রেখে কথা বলতেন। কখনো ওইভাবেই সুবিনয়ের সঙ্গে সন্দেশ পত্রিকা, ইউ. রায় এণ্ড সন্স বা অন্য কোন জটিল বৈষয়িক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন৷
পিতার মতোই সুকুমার স্বাস্থ্যের সন্ধানে ঘুরলেন—দাজিলিং, শান্তিনিকেতন। সোদপুর-পানিহাটিতে জমিদার গোপালদাস চৌধুরী তাঁর চণ্ডীমণ্ডপে দরমা দিয়ে ঘিরে সুন্দর থাকার জায়গা করে দিয়েছিলেন। সেখানে কিছুদিন রইলেন। গঙ্গার ধারে পশ্চিমের জানলার পাশে শুয়ে সূর্যাস্তের রঙিন ছবি আঁকলেন। স্বাস্থ্য খুঁজে পেলেন না—ফিরে এলেন।
শান্ত, সমাহিত মনে কাজ করে চললেন। প্রিয় শিশুদের জন্য কবিতায় ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাস ‘অতীতের ছবি’ আর একটি স্তোত্র—‘নমি সত্য সনাতন নিত্যধনে’ রচনা করলেন।
আচার্য ক্ষিতিমোহন এসে পুরনো ভক্তিকথা শোনাতেন আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান শোনাতেন। শেষ যেদিন কবি গাইলেন সেদিন সুকুমার নিজে চেয়ে শুনলেন
“দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো,
গভীর শান্তি এ যে।”
প্রথম প্রভাতেই জীবনসূর্য অস্ত গেল। অসামান্যা স্ত্রী সুপ্রভা, প্রতিভার ধারাবাহী শিশুপুত্র সত্যজিৎ আর স্নেহমুগ্ধ ভাইবোনেরা পড়ে রইলেন। রূপবান, গুণবান, সহিষ্ণু, সুবিনয় রইলেন সেই ঝড়ের সাগরে ফুটো নৌকোর হাল ধরতে। তিনিও পারলেন না, স্বাস্থ্য ভেঙে গেল।
চার বছরের মধ্যে গড়পাড়ের বাড়ি ছেড়ে আসতে হল। পরিবারের সকলে নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়লেন। বিধুমুখী দেওর মুক্তিদারঞ্জনের বাড়িতে মারা গেলেন। স্বাধীনচেতা সুবিনয় সরকারি চাকরি করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডারে নানা রচনা দান করে চললেন। মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে তিনিও গেলেন।
তবু শেষ হল না। সুকুমারের মত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ তাঁর একটা কবিতা স্বহস্তে লিখে সুপ্রভাকে পাঠিয়েছিলেন—
“শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?
আঘাত হয়ে দেখা দিলে,
আগুন ছিল এই পরিবারে; তাই যে-সব গুপ্ত আঘাতে তরী ডুবেছিল সেটা ইতিহাস নয়—ঝড়ে জলে অবিচলিত প্রতিভার দীপশিখাই সত্য।