পাতা:সুকুমার রায় রচনাবলী-প্রথম খণ্ড.djvu/৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চেয়ে দেখে শুয়োর কোথাও নাই; পালের মধ্যে নাই, মাঠের মধ্যে নাই, পুরীতে যাবার পথেও নাই! তা হলে নিশ্চয় বনের দিকে গেছে, এই ভেবে তারা দুজনে গেল বনের মধ্যে খুঁজে দেখতে।

 খুঁজতে খুঁজতে, ঘুরতে ঘরতে, বেলাশেষে যখন তারা শ্রান্ত হয়ে পড়লো, তখন চেয়ে দেখে—কোথায় মাঠ, কোথায় পুরী, তারা গভীর বনে এসে পড়েছে। দেখে তাদের বড় ভয় হল, বনের মধ্যে কোথায় যাবে? এমন সময়ে আঁধার বন ঝলমলিয়ে বনের দেবী চন্দ্রাবতী তাদের সামনে এসে বললেন, “ভয় পেয়েছ? এসো, এসো, আমার ঘরে এসো।” তারা তাঁর সঙ্গে গেল।

 বনের মধ্যে প্রকাণ্ড যে বুড়ো বট, তার জটায় ঢাকা বিশাল দেহে চন্দ্রাবতী আঙুল দিয়ে ছুঁতেই গাছের গায় দরজা খালে গেল। সেই দরজা দিয়ে রাজপুত্র আর রাজকন্যা ভেতরে ঢুকে দেখলো, কি চমৎকার পুরী! সেইখানে হরিণের দুধ আর বনের ফল খেয়ে, তারা সবুজ চাদরঢাকা কচি ঘাসের নরম বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লো। ভোরের বেলা গাছের ফোকরের জানালা দিয়ে এক টুকরো দিনের আলো যেমনি এসে পুরীর মধ্যে পড়েছে, অমনি পাখিরা সব গেয়ে উঠলো; রাজার ছেলে আর রাজার মেয়ে অবাক হয়ে ডঠে বসলো। চন্দ্রাবতী বললেন, “এখন ভেবে বল দেখি, আমার কাছে থাকবে, না রাজপুরীতে ফিরে যাবে?”

 তারা দুজনেই মাথা নেড়ে বলল, “না, না, দুষ্টু পুরীতে আর কক্ষনো যাব না। তার চাইতে বনের পুরী অনেক ভালো।”

 সেই থেকে রাজপুত্র আর রাজকন্যা বনপুরীতেই সুখে থাকে। বনের যত পশুপাখি, চন্দ্রাবতীকে সবাই চেনে। তারা এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে, গল্প করে আর কত মজার মজার কথা বলে; দুজনে অবাক হয়ে সেই-সব শোনে। একদিন এক বুড়ো কাক, জানালা দিয়ে উড়ে এসে সিন্দুকের ওপর আরাম করে বসে বলল, “কাঃ কাঃ, ক্যায়া বাৎ!” চন্দ্রা বললেন, “এই যে, ভুষুণ্ডিদাদা যে! খবর-টবর কিছু আছে?” কাক বলল, “হ্যাঁ, খবর বেশ ভালোই। কাঠুরেরা সে বছর যত জঙ্গল কেটেছিল, সব আবার ভরিয়ে দেবার ব্যবস্থা হচ্ছে।” চন্দ্রা বললেন, “সে কিরকম?” কাক বলল, “শহরের মানুষ এসে সারাদিন খালি মাটি খুঁড়ছে আর বীজ লাগাচ্ছে, আবার নতুন বীজ খুঁজে আনছে।” চন্দ্রা বললেন, “তারা এরকম করছে কেন?” কাক বলল, “ওমা, তাও জান না? তোমার এই নন্দবন পার হলেই খণ্ডবন, তার পরে অন্ধবন। মানুষপুরের লোকেরা এসে সেই অন্ধবনের বড়-বড় গাছ কেটে নিয়েছে। তাই অন্ধরাজ দুটো জাঁদরেল মানুষ পাকড়াও করে তাদের দিয়ে বন সারাচ্ছেন।” চন্দ্রা বললেন, “আহা, তা হলে তো মানুষ বেচারিদের বড়ই কষ্ট।” কাক বলল, “তা, কষ্ট তো আছেই। ঘরবাড়ি, ছেলেপুলে, সব ছেড়ে বনের মধ্যে খাটছে, খাটছে, কেবলই খাটছে। যতদিন না কাটা জঙ্গলের সমস্ত জমিতে বীজ পোঁতা হয়, যতদিন না সেই বীজ থেকে চারা বেরোয়, যতদিন না সেই চারা বাড়তে বাড়তে গাছ হয়ে ওঠে, ততদিন তাদের ছুটি নেই।” বলে কাক উড়ে গেল।

 কাকের কথা শুনে রাজপুত্র আর রাজকন্যা কাঁদতে লাগলো। তারা বলল, “আমরা অন্ধবনে যাব, আমাদের পথ বলে দাও।” চন্দ্রা বললেন, “নদীর ধার দিয়ে দিয়ে উত্তরমুখী চলে যাও, তা হলেই অন্ধবন খুঁজে পাবে। তার কাছেই ভুষুণ্ডি কাক থাকে, সে তোমাদের পথ দেখাবে। সত্যি কথা ছাড়া আর কিছু বলবে না। নদীর জল

দেশ-বিদেশের গল্প
৭৭